
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সোনার পাথরবাটি বা কাঁঠালের আমসত্ব বলে প্রচলিত কিছু কথা আছে। যার অর্থ প্রায় অসম্ভব বস্তু। অন্যদিকে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোও দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বহুল ব্যবহৃত বাক্য। খুব বেশি দিন আগে নয়, কিছুদিন আগেও জাতীয় ফল কাঁঠাল দিয়ে আমসত্ত্ব বানানো প্রায় বাস্তব একটি বিষয়ে পরিনত হয়েছিলো। সে সময় কাঁঠাল দিয়ে আমসত্ত্ব তৈরি করা না হলেও কাঁঠাল দিয়ে বার্গার অথবা মিষ্টি কুমড়া দিয়ে বেগুনি বানানোর প্রয়াস অসংখ্য ব্যক্তি এবং গণমাধ্যমের প্রশংসা এবং সাধুবাদও কুড়িয়েছিল।
এবার আসা যাক কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানোর প্রসঙ্গে। লেখাটিতে যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে, তা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামল। কাঁঠালের বার্গার, মিষ্টি কুমড়ার বেগুনি কিংবা ফ্রিজে কম দামে কেনা ডিম সেদ্ধ সংরক্ষণের বিষয়গুলো নিয়ে যেসব ব্যক্তি বা গণমাধ্যম দ্বিমত পোষণ করেছিলো তাঁদের অনেককেই সে সময়ে কিলিয়ে কাঁঠাল পাঁকানোর একটা পরিকল্পনা যে ছিল এবং অনেক ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নও করা হয়েছিল তা অনেকেই ভুলে যাননি।
ওপরের দুটো বিষয় সামনে আনার পেছনে একটি কারণ, বর্তমানে বহুল আলোচিত শব্দ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। বিশ্বে ঘটমান বাস্তবতায় একটি শব্দ বেশ ব্যবহৃত হয়। যাকে বলে ম্যাজিক রিয়েলিজম। শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্যের ধারা পেরিয়ে যে শব্দটি জড়িয়ে গেছে আমাদের ঘটমান বাস্তব জগতে। যেখানে অসম্ভব বলে কিছু নেই। যেখানে বাস্তবতাটা এক ধরণের ম্যাজিকের মতো। যে বাস্তবতায় আকাশে পুঁটিমাছ ধরা যায়, পাখি দিয়েও করা যায় হালচাষ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বিগত ১৬ বছরের দেশ পরিচালনা পদ্ধতিতে এই ম্যজিক রিয়েলিজমটাই বাস্তব হয়েছিলো। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে ৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হবার পর সেটিকে সামান্য অর্থ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। মাটি নরম বলে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয়ে ব্রিজ নির্মাণে উৎসাহ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বালিশ কাণ্ড, সিন্ডিকেট বাণিজ্য, স্বাস্থ্যখাতের ভুত, বেমালুম গুম, বিচার বিহীন খুন। সবকিছুই খুব সাধারণ একটি বিষয়ে পরিণত হয়। আর এর সামনে প্রথম আলোর রোজিনা ইসলামের মতো যাঁরা অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ করতে যান, তাঁদের প্রতি নির্যাতন, জেল, জুলুম বা পরিনতি কেবল বাংলাদেশ নয় দেখেছে গোটা বিশ্ব। বৈশ্বিক চাপে রোজিনা ইসলামকে সেদিন সরকার ছাড়তে বাধ্য হলেও, শেখ হাসিনা আমলে কলমের মুখে লাগাম চেপে দিয়েছিলো সাংবাদিক দম্পতি সাগর রুনী হত্যাকাণ্ড। যে ঘটনার বিচার আজও দেখতে পায়নি জাতি। চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট।
সাংবাদিকদের নূন্যতম অধিকার, প্রাপ্তির অবস্থান না রেখে মুখে শেকল এঁটে, পেছনে গোয়েন্দা বহর লাগিয়ে হাসিনা সরকার দিনকে রাত, রাতকে দিন করেছেন এটি বলাই বাহুল্য। তবে সবকিছুর পরেও কথা থেকে যায়।
শেখ হাসিনার শাসনামলে, স্বৈরাচার সরকার পতনের নেপথ্যে থাকা অন্যতম প্রধান কিছু যোদ্ধা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ছদ্মেবেশে ছিলেন ছাত্রলীগের ব্যনারে। দীর্ঘদিন ছাত্রলীগে থেকে দেশের স্বৈরতন্ত্র ভাঙ্গার কাজে কাজ করে গেছেন গোপনে। এখানে বলতেই পারেন, ধান ভানতে শিবের গীত। এই গীতটুকু প্রসঙ্গিক করতে একটি বিষয় সামনে আনা প্রয়োজন। আর তা হলো, হাসিনার শাসনামলে গণমাধ্যম এবং তার ভূমিকা।
সম্প্রতি রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টার (বিজেসি) আয়োজিত “গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা” অনুষ্ঠানে, গত ১৫ বছরের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
এ সময় প্রেস সচিব বলেন, গত ১৫ বছরে দেশে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন হয়েছে এবং বহু মানুষ গুম ও হত্যার শিকার হয়েছে। বিএনপির অভিযোগ, তাদের নেতাকর্মীদের নামে প্রায় ৬০ লাখ মামলা হয়েছিল তৎকালীন সরকারের আমলে। এই সময়ে সাংবাদিকতার ভূমিকায় আমরা কতটা নিরপেক্ষ ছিলাম, তা এখন মূল্যায়নের সময় এসেছে।
শফিকুল আলম বলেন, একজন সাংবাদিকের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতে পারে, তবে তার কাজ হওয়া উচিত তথ্যভিত্তিক ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন। বিগত সরকারের সময় সাংবাদিকতা ছিল সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন। এখন অন্তর্বর্তী সরকার সেই নিয়ন্ত্রণ থেকে সাংবাদিকতাকে মুক্ত করতে কাজ করছে।
তিনি দাবি করেন, গত ১১ মাসে অন্তর্বর্তী সরকার গণমাধ্যমের জন্য একটি উন্মুক্ত পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করেছে। এর অংশ হিসেবে বিতর্কিত ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিল করে নতুন ও গণমাধ্যমবান্ধব আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।
প্রেস সচিব বলেন, বর্তমানে সরকার গণমাধ্যমে ন্যূনতম হস্তক্ষেপ করছে না এবং কোনো সংস্থা যেন সাংবাদিকদের ভয় দেখাতে না পারে, সেজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে গণমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম কেউ যেন মিথ্যা প্রচারের কাজে ব্যবহার না করে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
আবার ফিরে যাই শেখ হাসিনার ম্যজিক রিয়েলিজম এবং হিরক রাজ্য প্রেক্ষাপটে। বারবার দেশের গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সময়ের গণমাধ্যমের ভুমিকার কথা বলতে শোনা যায়। কিন্তু অনেকেই ভুলে যান সে সময়ের বাস্তবতা এবং পরিস্থিতির বিষয়টি। এক সময় সরকারি গোয়েন্দা বাহিনী, আয়নাঘর আর সরকারি বাহিনীর চোখ রাঙ্গানির মাঝে কাজ করে গেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। কেউ কেউ নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে, কেউ নির্ঝঞ্ঝাট থাকতে, কেউ সরকারি বাহিনীর আওতা থেকে বাঁচতে গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার সময়টি পার করেছেন। কার্টুনিস্ট কিশোরের মতো অনেকেই তার শাসনামলে প্রাণ দিয়েছেন। কেউ কেউ গিয়েছেন নেহায়েত সুবিধার খাতিরে।
সময় এখন বদলেছে। বদলেছে শেখ হাসিনা সরকার। পতন হয়েছে স্বৈরতন্ত্রের। সময়ের সাথে সাথে এখন উচ্চারণ হচ্ছে স্বাধীন গণমাধ্যমের কথা। তবে এই কথা কি কেবল কথার কথা নাকি এখানে রয়েছে কোন গুণগত পরিবর্তন?
স্বাধীন গণমাধ্যম বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি আজ পর্যন্ত দেশের কোন সরকারই খুব বেশি পছন্দ করেছেন, এই কথাটি সত্য বলে ধরে নেবার সুযোগ কতটুকু আছে তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ থেকেই যায়। অদৃশ্য হাত, অদৃশ্য বলয়, অদৃশ্য শক্তি আজীবনই গণমাধ্যমকে এক অঘোষিত বলয়ে আটকে রেখেছে। গণমাধ্যমের কণ্ঠস্বর আটকে রেখেছে বৃহৎ পুঁজির শক্তি। এখনও রয়েছে স্বৈরাচার সরকারের ট্রমা। স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর কতটুকু মুক্ত হতে পেরেছে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলে পরিচিত গণমাধ্যম। হাসিনা সরকার ক্ষমতায় নেই, কিন্তু কতটুকু স্বাধীন হতে পেরেছে গণমাধ্যম। মবতন্ত্র, সাংবাদিকের জীবনের নিরাপত্তা, চাকরির নিরাপত্তা, স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার থেকে যাওয়া ভয়ের ছায়া থেকে বের হতে পেরেছে কি গণমাধ্যম? স্বাধীনতার মানদণ্ডে সেল্ফ সেন্সরশিপের বেড়াজালে, বিশেষ গোষ্টির প্রতি অনুরাগ, চাপের মুখে সংবাদপ্রকাশ; গণমাধ্যম কি ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে পরছে? দিন শেষে কি স্বাধীন গণমাধ্যম একটি সোনার পাথরবাটি বা কাঠালের আসমত্ত্ব থিউরি হয়ে দাঁড়াচ্ছে? প্রশ্ন করার জায়গাটুকু তো থাকেই।