
বাংলাদেশ আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে রাজনীতি, প্রশাসন, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রীয় কাঠামো গভীর অনিশ্চয়তার মুখোমুখি। একটি সময়োচিত রাজনৈতিক সংস্কারের পরিবর্তে দেশে জন্ম নিয়েছে অস্থিতিশীলতা, নিপীড়ন এবং আস্থার ভয়াবহ সংকট। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, শৃঙ্খলা ও সংহতি রক্ষার দায়িত্ব শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর আর নির্ভর করা যাচ্ছে না। বরং জাতির দৃষ্টি এখন নিবদ্ধ একমাত্র এমন একটি প্রতিষ্ঠানের দিকে, যেটি অতীতে যেমন দক্ষতা, সততা ও পেশাদারিত্বের নজির স্থাপন করেছে, তেমনি বর্তমানে হয়ে উঠেছে আশার প্রতীক—এটি হলো বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
বর্তমান রাজনৈতিক সংকট কেবল একটি নির্দিষ্ট নির্বাচনের বা দলীয় বিরোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি কাঠামোগত বিপর্যয়, যেখানে দীর্ঘ সময় ধরে গণতন্ত্রের মৌল ভিত্তিগুলো একে একে ক্ষয়ে গেছে। এর চেয়েও বড় সমস্যা হলো—সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে। রাজনীতি হয়ে পড়েছে সীমিত গোষ্ঠীর সুবিধাভোগের একটি কর্পোরেট মঞ্চ, যেখানে জনগণের সমস্যা, ক্ষোভ ও চাহিদা নেই। ৫ আগষ্ট পরবর্তী সময়ে এসেও এই অচলাবস্থার প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রে একধরনের ‘নিয়ন্ত্রিত অরাজকতা’ সৃষ্টি হয়েছে।
এই বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকা শুধু কাঠামোগত নয়, বরং নৈতিক ও ঐতিহাসিক দায়িত্বের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের একটি শক্তিশালী, প্রশিক্ষিত, পেশাদার ও নিরপেক্ষ বাহিনী হিসেবে সেনাবাহিনীর ওপর এখন নির্ভর করছে জাতির ভবিষ্যৎ। দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনী নিজেকে রাজনীতি থেকে দূরে রেখে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নে দক্ষতা দেখিয়েছে। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় শুধু সহায়ক ভূমিকা যথেষ্ট নয়। বরং সময়ের দাবি হলো, সেনাবাহিনীকে নিতে হবে একটি কৌশলগত নেতৃত্বের জায়গা, যেখানে তারা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ও সাংবিধানিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সক্রিয় থাকবে।
২০২৪ সালের ৫ই আগস্টের ঘটনার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন মোড় এসেছে। দেশে দীর্ঘকাল ধরে চলা স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটেছে, এবং একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসেছে—যার মূল দায়িত্ব একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। এ ঘটনাপ্রবাহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাদের নিরপেক্ষতা ও দায়িত্ববোধ দিয়ে যে ভূমিকা রেখেছে, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় ও যুগান্তকারী। স্বৈরতান্ত্রিক অব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থার সূচনা কেবল বাহিনীর সাংবিধানিক দায়বদ্ধতারই বহিঃপ্রকাশ নয়, এটি জাতির কাছে একটি নির্ভরতার বার্তাও।
দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এখনও ভঙ্গুর। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কর্মকাণ্ড চালু করেছে এবং নির্বাচনমুখী প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবু পুরনো বিভেদ, অর্থনৈতিক দুরবস্থা এবং সুশাসনের অভাব এখনও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এই বাস্তবতায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা আরও গভীর, আরও জটিল। তারা এখন শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলা দেখাই নয়, বরং একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের অন্যতম রক্ষাকর্তা। ইতিহাস সাক্ষী, বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সবসময়ই একটি ন্যায্যতা এবং আস্থার প্রতীক হয়ে এসেছে। তাদের নিরপেক্ষ ও নিয়ন্ত্রিত হস্তক্ষেপ ভোটারদের সাহস জুগিয়েছে এবং অনিয়ম প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রেখেছে।
তবে সেনাবাহিনীর এই ভূমিকা কেবল নির্বাচনকালীন দায়িত্বে সীমিত রাখা যায় না। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় যখন বিদেশি বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন একটি স্থিতিশীল ও নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করতে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি এবং মনোভাব কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী কেবল সামরিক প্রয়োজনে নয়, উন্নয়ন কাঠামোর অংশ হিসেবেও আজ অপরিহার্য।
সেনাবাহিনীর ভূমিকায় আন্তর্জাতিক মাত্রাও ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক কৌশলগত চ্যালেঞ্জ এবং আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে নানাভাবে চাপে ফেলছে। এমন একটি সময়ে দেশের সীমান্তরক্ষা এবং বাহ্যিক হস্তক্ষেপ প্রতিরোধে সেনাবাহিনীই একমাত্র শক্তি, যারা জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। তবে শুধু সীমান্তেই নয়, দেশের অভ্যন্তরেও যখন বিদ্রোহ, সহিংসতা এবং অরাজকতার আশঙ্কা দেখা দেয়, তখন সেনাবাহিনীর উপস্থিতি ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাষ্ট্রীয় সংহতির জন্য অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়।
৫ আগস্টের ঐতিহাসিক ভূমিকায় সেনাবাহিনী প্রমাণ করেছে যে তারা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনও দলীয় পক্ষ নেয় না, বরং তারা একটি শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক এবং সাংবিধানিক ব্যবস্থার পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করতে সক্ষম। একটি অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর যে আশাব্যঞ্জক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, তা টিকিয়ে রাখতে হলে সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষতা ও সদিচ্ছা অব্যাহত রাখা জরুরি। নির্বাচনকালীন সহায়তার পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় কোনও অরাজকতা সৃষ্টি হলে তা রোধে সেনাবাহিনীর প্রস্তুতি ও কৌশলগত সক্রিয়তা জরুরি।
অবশ্য সেনাবাহিনীর এই শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সতর্কতা ও সংযমের পরিচয় দেওয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেনাবাহিনীর কৌশল হওয়া উচিত—গণতন্ত্র ও সুশাসনের পথে রাষ্ট্রকে সুরক্ষিত রাখতে সহযোগিতা করা এবং এই উদ্যেশ্যে দেশকে নেতৃত্ব দেয়া। এতে করে সেনাবাহিনী যেমন পেশাদার মর্যাদা বজায় রাখতে পারবে, তেমনি জাতিও পাবে একটি নতুন ভরসার ঠিকানা।
বাংলাদেশ আজ এক গভীর রাজনৈতিক ও নৈতিক সঙ্কটে। এই সংকট থেকে উত্তরণ কেবল রাজনৈতিক সমঝোতার মাধ্যমে সম্ভব নয়, প্রয়োজন একটি শক্তিশালী, নিরপেক্ষ এবং দূরদর্শী শক্তি—যার মধ্যে রয়েছে প্রশাসনিক দক্ষতা, জনআস্থা এবং সাংবিধানিক অনুগত্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীই এখন সেই শক্তি, যাদের ওপর জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। তাদের দায়িত্বশীল ভূমিকা কেবল একটি অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করেই থেমে যাবে না, বরং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামো নির্মাণেও তারা হতে পারে নেপথ্যের অদৃশ্য স্থপতি।
এই প্রেক্ষাপটে, সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে কেন্দ্র করে কৃতজ্ঞতা, সহায়তা এবং আস্থা জ্ঞাপন করাই এখন সময়ের দাবি। কারণ ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে—যখন রাজনীতি ব্যর্থ হয়, তখন পেশাদারিত্ব, দেশপ্রেম এবং জনগণের নিরাপত্তার প্রশ্নে সেনাবাহিনীই হয়ে ওঠে জাতির শেষ ভরসা। আজ বাংলাদেশে সেই মুহূর্তই বিরাজ করছে, যেখানে সেনাবাহিনীর অপরিহার্যতা কেবল সময়ের প্রয়োজন নয়, বরং রাষ্ট্রের টিকে থাকার প্রধান ভিত্তি।