
বাংলাদেশের কর্পোরেট জগতে হোসেন খালেদ এক পরিচিত মুখ। তবে তার যাত্রা কেবল পারিবারিক ঐতিহ্যের ওপর দাঁড়িয়ে নয়। উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের সাফল্য, ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং প্রযুক্তিনির্ভর ভবিষ্যৎ ভাবনা, এই তিন মিলিয়ে তিনি আজ দেশের অন্যতম আলোচিত কর্পোরেট নেতা। আগস্ট ২০২৪-এ সিটি ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান পদে তার নিয়োগ ব্যাংকটির জন্য যেমন নতুন অধ্যায়ের সূচনা, তেমনি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতেও এক প্রতীকী মুহূর্ত।
শুরুটা পরিবার থেকেই। তার বাবা, মরহুম আনোয়ার হোসেন, আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা, ছিলেন দেশের শিল্প-বাণিজ্যের এক কিংবদন্তি। স্টিল, টেক্সটাইল, সিমেন্ট, অটোমোবাইল থেকে রিয়েল এস্টেট, প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অবদান স্পষ্ট। ৭০ ও ৮০’র দশকে যখন বাংলাদেশের শিল্পায়ন এখনো শুরুর পর্যায়ে, তখন আনোয়ার হোসেনের মতো উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে পথ তৈরি করেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই এসব কার্যক্রমের সঙ্গে পরিচিত হোসেন খালেদ ব্যবসা ও অর্থনীতিকে শুধু সংখ্যার খেলা নয়, বরং মানুষের জীবনমান পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধরণের ইতিবাচক পরিবর্তন রেখে চলেছেন হোসেন খালেদ।
তার শিক্ষাজীবনের একটি বড় অংশ ছিলো যুক্তরাষ্ট্রে। ইউনিভার্সিটি অব টোলেডো থেকে অ্যাকাউন্টিংয়ে বিবিএ, এরপর টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটি থেকে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিংয়ে এমবিএ তাকে দিয়েছে এক বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি। সেখানে তিনি দেখেছেন কীভাবে প্রযুক্তি, নীতি ও পুঁজি একসঙ্গে কাজ করে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবাহ তৈরি করে। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “বিদেশে পড়াশোনা আমাকে বুঝিয়েছে, অর্থনীতি কোনো সীমানা মানে না। সিদ্ধান্ত এক প্রান্তে হয়, প্রভাব পড়ে আরেক প্রান্তে।”
পড়াশোনা শেষে তিনি যোগ দেন আনোয়ার গ্রুপে। গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে তার নেতৃত্বে কোম্পানি আধুনিক সাপ্লাই চেইন, ডিজিটাল মার্কেটিং এবং আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য রপ্তানিতে নতুন মাত্রা পায়। রিয়েল এস্টেট প্রকল্পগুলোতে তিনি সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়েছেন, টেক্সটাইল ইউনিটে অটোমেশন এনেছেন, এবং স্টিল ও পলিমার সেক্টরে নতুন পণ্য বাজারে এনেছেন।
সিটি ব্যাংকের সঙ্গে তার সম্পর্ক পারিবারিক ইতিহাস আর অবদানের অংশ। ব্যাংকটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন তার বাবা। ২০১৭ সাল থেকে সাত বছর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ব্যাংকের কৌশলগত পরিকল্পনা, কর্পোরেট গভর্নেন্স এবং ডিজিটাল সেবা উন্নয়নে সক্রিয় ছিলেন। সিটি ব্যাংকের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় তিনি ছিলেন নেপথ্য নায়ক।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত যখন নানা অনিশ্চয়তা ও প্রতিযোগিতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন তারই নেতৃত্বে সিটি ব্যাংক নিজেদের যাত্রাপথকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। ২০২৪ সাল ব্যাংকের ইতিহাসে ছিলো একটি মাইলফলক। এ বছর ব্যাংকটি এক হাজার কোটি টাকার বেশি নিট মুনাফা অর্জন করেছে। সংযুক্তভাবে লাভ হয়েছে ১,০১৪ কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় ৫৯ শতাংশ বেশি। শুধু তাই নয়, বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে তাদের অপারেটিং প্রফিট বেড়েছে ৭৭ শতাংশ, যা ব্যাংকের পরিচালন দক্ষতা ও ব্যবসায়িক কৌশলের সাফল্যকে স্পষ্ট করে। ২০২৫ সালেও এই ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে সিটি ব্যাংক নতুন বিনিয়োগ ও সম্প্রসারণ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। সম্প্রতি নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে তারা ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বিশেষ ঋণ সুবিধা পেয়েছে, যা ব্যবহার হবে টেকসই অবকাঠামো, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি এবং ডিজিটাল উন্নয়নের প্রকল্পে। এই উদ্যোগ শুধু ব্যাংকের পোর্টফোলিও বৈচিত্র্য বাড়াবে না, বরং দেশের অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। যার পেছনে হোসেন খালেদের বিশেষ অবদান। মোবাইল ব্যাংকিং, ডিজিটাল ঋণ অনুমোদন, অনলাইন পেমেন্ট সলিউশন এসব উদ্যোগে তার সরাসরি ভূমিকা ছিল।
২০২৪ সালের আগস্টে পরিচালনা পর্ষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে হোসেন খালেদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই সময় ব্যাংকিং খাতে সিটি ব্যাংক তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় থাকলেও, প্রতিযোগিতা ও প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ এখানে সমানভাবে উপস্থিত।
সিটি ব্যাংকের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যাংকের নিট মুনাফা আগের বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেড়েছে। খেলাপি ঋণের হার ৩ শতাংশের নিচে রাখা সম্ভব হয়েছে, যা জাতীয় গড়ের তুলনায় অনেক কম। গ্রাহক আমানত বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ, বিশেষ করে রিটেইল ব্যাংকিং ও এসএমই সেগমেন্টে। ডিজিটাল লেনদেনের হারও দ্বিগুণ হয়েছে, যা নির্দেশ করে প্রযুক্তি গ্রহণে গ্রাহকদের আগ্রহ বাড়ছে।
চেয়ারম্যান হিসেবে হোসেন খালেদের চ্যালেঞ্জ এই স্থিতিশীলতাকে ধরে রেখে ব্যাংকিং খাতেকে নতুন দিগন্তে প্রসারিত করা। তার পরিকল্পনায় তিনটি অগ্রাধিকার রয়েছে: প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং, গ্রাহক আস্থা, এবং টেকসই উন্নয়ন। তার ভাষায়, “আমি চাই সিটি ব্যাংক শুধু দেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার একটি রোল মডেল হোক।”
প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তিনি ফিনটেক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ব্লকচেইনকে ব্যাংকিংয়ের ভবিষ্যতের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখেন। ঋণ অনুমোদন থেকে শুরু করে ঝুঁকি বিশ্লেষণ, গ্রাহক সেবা থেকে লেনদেন নিরাপত্তা প্রতিটি স্তরে প্রযুক্তির গভীর প্রয়োগে তিনি জোর দেন।
গ্রাহক আস্থা তার জন্য দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তিনি বিশ্বাস করেন, ব্যাংকিং সেক্টরে দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা অপরিহার্য। “গ্রাহক শুধু আপনার সুদ হার বা ফি দেখে ব্যাংক বেছে নেয় না, তারা দেখে আপনি কতটা বিশ্বাসযোগ্য,” তিনি বলেন।
টেকসই উন্নয়নে তিনি সামাজিক দায়বদ্ধতাকে অন্তর্ভুক্ত করছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সংরক্ষণে ব্যাংকের সিএসআর কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত হবে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সবুজ প্রকল্পে বিনিয়োগ তার পরিকল্পনার অংশ।
হোসেন খালেদের ব্যবসায়িক যাত্রা ব্যাংকিংয়ের বাইরেও প্রভাব ফেলেছে। তিনি চার মেয়াদে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি ছিলেন, যেখানে তিনি ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়ন ও বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশ বেটার বিজনেস ফোরামের সহ-সভাপতি এবং এন্টারপ্রেনিউরস’ অর্গানাইজেশন (EO) বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে তিনি উদ্যোক্তাদের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন।
বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে তার নেতৃত্বে সিটি ব্যাংকের ভূমিকা আরও ইমপ্যাক্টফুল হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডলার সংকট, মুদ্রাস্ফীতি, খেলাপি ঋণের চাপ এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত সরাসরি প্রভাব ফেলবে শিল্প-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে। আশা করা হচ্ছে তার নেতৃত্বে সিটি ব্যাংক প্রযুক্তি, স্বচ্ছতা এবং গ্রাহককেন্দ্রিক সেবায় এগিয়ে যাবে, যা ব্যাংকটি শুধু বাজারের শীর্ষে নয়, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম চালক হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
সবশেষে, হোসেন খালেদের যাত্রা প্রমাণ করে, একজন ব্যবসায়ী নেতা কেবল আর্থিক মুনাফা দিয়ে মূল্যায়িত হন না। নেতৃত্ব, ভিশন, সততা এবং পরিবর্তনের ক্ষমতা এই চার গুণই তাকে আলাদা করে তুলেছে। সিটি ব্যাংকের নতুন অধ্যায় তাই শুধু একটি ব্যাংকের গল্প নয়; এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনাও হতে পারে।