রাজু আলীম…
স্বৈরাচার রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার অত্যাচারে বছরের পর বছর নিষ্পেষিত জনতার পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে গেল; তখনও যেন প্রতিবাদ করার অবশিষ্ট শক্তি টুকু জোগাড় করতে পারছিলাম না আমরা। চারিদিকে শুধু আতঙ্কিত পরিবেশ। মস্তিষ্কের পুরোটা জুড়েই শুধু ভয়ের উপস্থিতি। ঘরবাড়ি হারানোর ভয়, ব্যবসা হারানোর ভয়, চাকরি হারানোর ভয়, ছাত্রত্ব হারানোর ভয়, সর্বোপরি জীবন হারানোর ভয়ে মাথা নুইয়ে, মেপে মেপে চলতে এবং কথা বলতেই আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। এটাকেই আমরা পরিপক্কতা, বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি ইত্যাদি বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার কাজটা সেরে নিতাম।
এক যুগেরও বেশি সময় বিরাজমান এরকম থমথমে পরিস্থিতিতে অনেকটা হুট করেই একদল মানুষের আবির্ভাব ঘটে। তারা সত্যিকার অর্থেই মানুষ ছিল। শুধুমাত্র শারীরিক গঠনের কারণে তাদের মানুষ বললে বিষয়টা আংশিক সত্য হবে। সৎ সাহস নিয়ে শিরদাঁড়া টান করে চোখে চোখ রেখে কথা বলা প্রকৃত মানুষ তারা। সেই মানুষের প্রজন্মকে নাকি ইংরেজি ভাষায় জেনারেশন জেড বা জেন-জি বলে ডাকা হয়। খুব নিবিড় ভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম তাদের ওপর সহজেই অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারছে না রাষ্ট্রযন্ত্র। এমনকি বল প্রয়োগ করেও কাজ হচ্ছে না।
“যখন অত্যাচারই আইন হয়ে যায়, বিদ্রোহ রীতি হয়ে যায়।” দক্ষিণ আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপ্লবী নেতা সাইমন বলিভারের এই উক্তি যেন বাংলাদেশের মাটিতে অনেক বেশি বাস্তব করে তুলেছিল এই জেন-জি জেনারেশন। ফলশ্রুতিতে আমরা পাই ২০২৪ সালের জুলাই মাস। ঐ জুলাইয়ে ঘটে যাওয়া গণতান্ত্রিক দাবিসমূহের সংগ্রাম ও হৃদয়বিদারক গণহত্যার কাহিনি এখনো জলন্ত স্মৃতির পাতায়। শুরু হয় কোটা সংস্কারের আন্দোলন থেকে, পরিণত হয় গণবিপ্লবে—প্রাণ হারানো শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, নিরীহ মানুষ, এবং অন্তর্মুখী দমন-পীড়নের মুখে পড়া অসংখ্য নিরপরাধের মিছিল হয় ঐ রক্তাক্ত জুলাইয়ে।
৫ জুন ২০২৪ তারিখে বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের এবং বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ কোটা ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে। রায় ঘোষণার পরপরই, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা এই রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে।
জুলাই মাসে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে, যেখানে শিক্ষার্থীরা ” বাংলা অবরোধ ” সহ বিভিন্ন অবরোধ করে। এই সময়ে, পুলিশ আন্দোলন দমন করতে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে, যার ফলে সংঘর্ষ হয়।
আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার “রাজাকারের নাতি পুতি” শব্দ সম্বলিত কিছু বাক্য। তার সেসব কথা ভাইরাল হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে স্লোগান ধ্বনিত হয় “তুমি কে আমি কে? রাজাকার-রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে? স্বৈরাচার-স্বৈরাচার’।” “‘চাইতে এলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার!” সেই স্লোগানগুলো এখনো স্মৃতিতে অম্লান।
শেখ হাসিনার তৈরি করা পুলিশি রাষ্ট্রে ১৫–১৬ জুলাই ২০২৪ এ একের পর এক হত্যাকাণ্ড হয়; বিশেষত রংপুরের আবু সাঈদ ও ঢাকার মীর মুগ্ধো–র নিহত হওয়া, আন্দোলনকে এক ভয়ানক মোড় দেয়। সেই থেকেই এটি “July Massacre” নামে পরিচিত।
১৮–২৮ জুলাই পর্যন্ত দেশব্যাপী ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট জারি হয়, সরকারের সন্দেহভাজন “shoot‑on‑sight” ঘোষণার মধ্যে পুলিশ, RAB, BGB ও ছাত্রলীগ—সহ একাধিক বাহিনী বিচ্ছিন্নভাবে আটক, আহত ও মৃতের সংখ্যা ১,৪০০+ পর্যন্ত শনাক্ত করা যায়; ২০ হাজারের ওপর হতাহত ও ১১ হাজারের অধিক গ্রেফতার হয়েছিল।সেসময় অবশ্য যোগাযোগের জন্য ইন্টারনেটের ভিপিএন অনেক উপকার করেছিল সাধারণ জনগণের।
শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে আসে আগস্ট মাসের ৫ তারিখ। সেই দিনটিকে “৩৬ জুলাই” বলে স্মরণ করা হয়। ঐ দিনে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন ও পলায়ন করে দেশত্যাগ করেন। ৮ আগস্ট ২০২৪ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় ফৌজদারি সময়কালীন অস্থায়ী সরকার। দেশ প্রথমবারের মতো এমন কাউকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পেয়েছে যে একই সাথে বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি এবং নোবেল বিজয়ী। জুলাইয়ের ত্যাগ এইভাবে আমাদের আরও একবার সম্মানিত করলো।
তবে গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস এই দেশে নতুন নয়। সেই ৭৫ এর ১৫ ই আগস্ট ৯০ এর অভ্যুত্থান সে সবকিছুই যেন বাংলাদেশকে নতুন রূপে সাজিয়েছে।
ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন নেতৃত্বে চূড়ান্তভাবে দেশের একটি অংশে নতুন রাজনৈতিক সংস্কার ও জাতীয় ঐক্য পুনরুজ্জীবিত হয়েছে—যা ২০২৫–২৬ সালের মধ্যে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আরও স্পষ্টতা আনতে পারে।
এদিকে পরাজিত এবং বিতাড়িত স্বৈরাচারের দলের গুটিকয়েক সমর্থক এখনো স্বপ্নে বিভোর যে আওয়ামী লীগ হয়তো নতুন রূপে ফিরে আসবে। তারা এই রক্তক্ষয়ী বিপ্লবকে কলুষিত করার চেষ্টা করে বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে। শেখ মুজিবের তৈরি বাকশাল শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ নামে ফিরছিল বাকশাল ২.০। তাই আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে এনে আবারো একশো বছর দাসত্বের শৃংখল নিশ্চয়ই কেউ পড়তে চাইবে না।
জুলাইয়ের সেই রুহানি বিপ্লবের এক বছর পেরিয়েছে। জুলাই যোদ্ধারা শুধুমাত্র কোটা সংস্কারের দাবিতে নয়—তারা স্বাধীন ও ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিল। সামরিক, রাজনৈতিক ও আধিপত্য বিস্তারের রোধে গণতন্ত্র এবং সম্প্রীতির আক্সন্ধ অন্বেষণ করেছে তারা।
তরুণ প্রজন্ম—বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী, সাংবাদিক, নারী, সংখ্যালঘু—মিলে রচনা করেছে নতুন এক রাষ্ট্রীয় জননেতা ও গণতান্ত্রিক ইতিহাস।
কি বিপ্লবের শহীদদের সম্মানে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব আমার আপনার সকলের। তারা তো আমাদেরকে দেখছে, কারণ যারা ন্যায়ের পথে জীবন বলিদান করেছে তাদের প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন “আর যারা আল্লাহর পথে জীবন দিয়েছে, তাদেরকে তুমি মৃত মনে করো না, বরং তারা তাদের রবের কাছে জীবিত। তাদেরকে রিজিক দেয়া হয়।”
রাজু আলীম
কবি ,সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব