
১৯৯৯ সালের ১ অক্টোবর যখন চ্যানেল আই যাত্রা শুরু করল, তখন আমরা কেবল একটি চ্যানেল গড়তে চাইনি—আমরা চেয়েছিলাম একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে। যেখানে সত্য, সৌন্দর্য, সংস্কৃতি, এবং মানুষের গল্পগুলো নান্দনিকভাবে বলার সুযোগ থাকবে। সেদিন যে ছোট্ট বীজ রোপণ করা হয়েছিল, আজ তা পরিণত হয়েছে একটি ছায়া দেওয়া মহীরুহে। এই ২৬ বছরের পথচলা ছিল উৎসর্গ, ত্যাগ, নিরলস পরিশ্রম আর প্রতিদিন নতুন কিছু শেখার অভিজ্ঞতা।সময়ের সাথে সাথে এই জায়গাটা শুধু আমার কর্মস্থল হয়ে থাকেনি; এটি হয়ে উঠেছে আমার প্রেরণা, আমার শেখার ক্ষেত্র, আমার ভালোবাসার জায়গা।
আমি সৌভাগ্যবান, কারণ শুরু থেকেই ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড চ্যানেল আইয়ের পরিচালনা পর্ষদ এর আবদুর রশিদ মজুমদার , এনায়েত হোসেন সিরাজ ,জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন ,ফরিদুর রেজা সাগর,মুকিত মজুমদার বাবু ,রিয়াজ আহমেদ খান এবং শাইখ সিরাজ নেতৃত্বে আমরা নাম্বার ওয়ান একটা টিভি চ্যানেলের সাথে যুক্ত হতে পেরেছি। এই পথ চলায় আমরা অংশ হতে পেরেছি। কত শত অনুষ্ঠান, কত শত মানুষ, কত গল্প! আমার তৈরি প্রতিটি অনুষ্ঠান, সিনেমা, নাটকের পেছনে ছিল একেকটি গভীর মানবিক অভিপ্রায়—কখনো কৃষকের হাসি, কখনো শিল্পীর অশ্রু, কখনো দেশের সংকটে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর দায়বদ্ধতা। এই চ্যানেলকে আমি কেবল একটি সম্প্রচারমাধ্যম হিসেবে দেখি না; আমি একে দেখি বাংলাদেশের মাটি, মানুষ আর সংস্কৃতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হিসেবে।
চ্যানেল আই এখন শুধু একটি টিভি চ্যানেল নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ মিডিয়া নেটওয়ার্ক হিসেবে প্রজন্মের দর্শকদের কাছে ডিজিটাল মাধ্যমে আরও বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতা ও কনটেন্ট নির্মাতাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সেই সুবাদে বিভিন্ন স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে চ্যানেল আই এর ব্যবসায়িক এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পেরে আমি বেশ আনন্দিত।

চ্যানেল আই এর স্যাটেলাইট টিভি থেকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। এই রূপান্তর শুধু প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রতিফলন নয়, বরং দর্শকসংখ্যা বৃদ্ধির, বিশ্বায়নের সাথে তাল মেলানোর এবং আধুনিক যুগে টিকে থাকার কৌশলের অংশ। আর এই কৌশলে সফল হওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে টেলিভিশন চ্যানেল ক্যাটাগরিতে বারবার সুপারব্র্যান্ডস বাংলাদেশ সম্মাননা পেয়েছে দেশের প্রথম ডিজিটাল টেলিভিশন চ্যানেল আই। চ্যানেল আই গ্লোবাল ব্র্যান্ডসে পরিণত হয়েছে, একথা বলাই বাহুল্য।
গণমাধ্যমে কাজ করার সময় এমন কিছু মুহূর্ত আসে, যেগুলো একদিকে যেমন কৌতূহল জাগায়, অন্যদিকে ভেতরটা কাঁপিয়ে দেয়। “টু দ্য পয়েন্ট”-এর অসংখ্য পর্ব পরিচালনার অভিজ্ঞতা থাকলেও একটি সন্ধ্যা আজও আমার মনে গেঁথে আছে, যেন এক জীবন্ত ফ্রেম—যা ভুলে যাওয়ার নয়।
সেদিন আমাদের আলোচনার টেবিলে উপস্থিত ছিলেন সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। আলোচনার বিষয় ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। কথাবার্তা ছিল গুছানো, শ্রুতিমধুর—একটি পরিপক্ব আলোচনার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু হঠাৎ করেই আলোচনার আবহ বদলে গেল।
কোনো প্রশ্ন বা মন্তব্য হয়তো বিচারপতিকে আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। তিনি তৎক্ষণাৎ উচ্চস্বরে, কিছুটা উত্তেজনার সুরে কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর ভাষা, ভঙ্গি এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে এক ধরনের জোরালো ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠছিল—যা লাইভ টেলিভিশনের পরিসরে সচরাচর দেখা যায় না। আমি তখন সঞ্চালকের একেবারে পাশে, নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নয়—স্টুডিওর মেঝেতেই উপস্থিত।
চারপাশটা যেন হঠাৎ থমকে গেল। আলো, ক্যামেরা, টেলিপ্রম্পটার—সব ঠিকঠাক চললেও, পুরো স্টুডিওর বাতাস ভারী হয়ে উঠল। দর্শক চোখে দেখতে পারেননি, কিন্তু আমরা যারা সরাসরি সেই মুহূর্তে ছিলাম, তারা বুঝেছিলাম—এটি ছিল এক অভূতপূর্ব, প্রায় বিস্ফোরক আবেগের বহিঃপ্রকাশ।
সঞ্চালক দীপ্তি চৌধুরী দ্রুততার সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেন, আলোচনাকে মূলধারায় ফেরাতে চাইলেন। আমিও ইশারায় টিমকে নির্দেশ দিলাম—কোনো বিভ্রান্তি বা উত্তেজনা যাতে সম্প্রচারে না ছড়ায়। আমরা জানতাম, সাংবাদিকতা মানে শুধু প্রশ্ন তোলা নয়—দায়িত্ব নিয়েও প্রশ্ন সামলানো।
অনুষ্ঠান শেষ হলো পেশাদারিত্বের সীমানায় থেকেই, কিন্তু এর প্রতিধ্বনি আরও অনেক দিন ছিল সহকর্মীদের আলোচনায়, দর্শকের প্রতিক্রিয়ায় এবং আমার নিজের চিন্তার গভীরে। বিচারপতি মানিকের পরের ইতিহাস তো এখ সবারই জানা ।
ব্যাপক ভাইরাল টু দ্য পয়েন্ট এর
কথা মনে পড়লে আমি এখনো বিস্মিত হই। এরকম হাজারো স্মৃতি আমার চ্যানেল জীবনে ,এটা লিখে শেষ করা যাবে না !
আজও যখন সেই পর্ব স্মরণ করি, মনে হয়—এটাই চ্যানেল আইয়ের “টু দ্য পয়েন্ট”-এর সত্যিকারের শক্তি। আমরা শুধু আলোচনা করি না, আমরা বাস্তবতাকে সম্মান করি, মতপার্থক্যকে জায়গা দিই, এবং সবকিছুর ওপরে মানুষের ভেতরের সত্যিটুকুকে বোঝার চেষ্টা করি।
চ্যানেল আই ২৭ বছরে পদার্পণ করলো। বয়স দিয়ে হিসেব করলে চ্যানেল আইও জেন-জি, হা হা হা। এই দীর্ঘ যাত্রা আমাদের জন্য যেমন গৌরবের, তেমনি অনুপ্রেরণারও। চ্যানেল আই আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে, আরও অনেক গল্প বলবে, আরও অনেক জীবনকে ছুঁয়ে যাবে— হয়তো শত বছর পর এই অগ্রগতি দেখার জন্য আমি উপস্থিত থাকবো না, তবে হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করে চ্যানেল আই এগিয়ে যেতেই থাকবে। চ্যানেল আই টু বি কন্টিনিউড…