রাজু আলীম
সম্পাদক, ইউএসএ বাংলা নিউজ
শিক্ষা কেবল জীবিকা অর্জনের মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি জাতির মেরুদণ্ড এবং সমাজ পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার, এই শাশ্বত সত্যকে ধারণ করে যিনি সিলেটের শিক্ষা মানচিত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন, তিনি ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী। সিলেটের গ্রামীণ জনপদে বেড়ে ওঠা এক সাধারণ শিশু থেকে আন্তর্জাতিক মানের একটি উচ্চশিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠাতা হওয়ার পথটি ছিল চ্যালেঞ্জিং কিন্তু তার অটল বিশ্বাস আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য উচ্চতায়। মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির প্রতিটি ইট-পাথরে মিশে আছে তার ঘাম, শ্রম এবং একটি আলোকিত প্রজন্ম গড়ে তোলার অদম্য আকাঙ্ক্ষা। তার জীবন ও দর্শন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি কেবল একজন উদ্যোক্তা নন, বরং একজন সমাজ সংস্কারক, যার মূল লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যের ঊর্ধ্বে উঠে নৈতিকতা ও মানবিকতার চর্চাকেন্দ্র তৈরি করা।
সিলেটের প্রাকৃতিক স্নিগ্ধতায় ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীর শৈশব কাটলেও তার স্বপ্ন ছিল আকাশছোঁয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা সমাপনের পর তিনি সোনালী ব্যাংকে কর্মজীবন শুরু করেন। ব্যাংকিং খাতের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাকে যেমন অর্থনৈতিক শৃঙ্খলা শিখিয়েছে, তেমনি প্রশাসনের জটিল পথ বুঝতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তার মন পড়ে ছিল শিক্ষার আঙিনায়। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, একটি সমাজকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বদলে দিতে হলে শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। ২০০২ সালের দিকে যখন বাংলাদেশে বেসরকারি উচ্চশিক্ষার ধারণাটি বিকশিত হচ্ছিল, তখন তিনি কেবল একটি ভবন বা কিছু ক্লাসরুমের কথা ভাবেননি; তিনি ভেবেছিলেন এমন একটি ‘আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয়ের’ কথা, যেখানে শিক্ষার্থীরা কেবল ডিগ্রি নেবে না, বরং মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে। এই চিন্তার ফসলই আজকের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি।
![]()
ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীর শিক্ষা-দর্শনের মূল ভিত্তি হলো ‘মানবিকতা’। তিনি সবসময় বিশ্বাস করেন যে, “শিক্ষা শুধু জ্ঞান দেয় না; শিক্ষা চরিত্র গঠন করে, দায়িত্ববোধ জাগায় এবং সমাজকে আলোকিত করে।” তার এই উক্তিটি কেবল কোনো স্লোগান নয়, বরং এটি তার জীবনের মূলমন্ত্র। ২০০৩ সালের ৩ মে যখন মাত্র ১৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে একটি ছোট ভাড়া করা কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়, তখন সম্পদ সীমিত থাকলেও তার সংকল্প ছিল আকাশচুম্বী। তিনি সেই প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সহযোদ্ধা মনে করতেন। তার অনুপ্রেরণাতেই সেই শিক্ষার্থীরা রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে লিফলেট বিলি করেছেন, কারণ তারা জানত তাদের অভিভাবক ড. তৌফিক কেবল ব্যবসা করতে আসেননি, এসেছেন একটি আদর্শের বীজ বপন করতে। আজ সেই ছোট্ট চারাগাছটি তিন হাজার শিক্ষার্থীর এক বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়েছে, যা তার নিরলস সাধনারই প্রতিফলন।
একজন স্বপ্নদ্রষ্টা হিসেবে ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী সবসময় গবেষণাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় তখনই পূর্ণতা পায় যখন সেখানে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হয়। এই ভাবনা থেকেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘সেন্টার ফর ট্রেইনিং, রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিকেশন’ (সিটিআরপি)। তিনি বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন যে, আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন কেবল চাকরিপ্রার্থী না হয়ে উদ্যোক্তা এবং সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে। তার মতে, উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য হওয়া উচিত বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, যারা একইসাথে নিজের শেকড় এবং নৈতিক মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরবে। তার এই দূরদর্শী চিন্তার কারণেই মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি আজ রাজনীতিমুক্ত, মাদকমুক্ত এবং বৈষম্যহীন এক অনন্য ক্যাম্পাসে পরিণত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীর ভূমিকা ছিল একজন মেন্টরের মতো। তিনি কেবল বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবে নথিপত্রে সীমাবদ্ধ থাকেননি, বরং শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকেছেন। তার পারিবারিক ও সহকর্মীদের সহযোগিতায় তিনি যেভাবে প্রতিকূলতা জয় করেছেন, তা বর্তমান প্রজন্মের তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এক বিশাল শিক্ষণীয় পাঠ। ২০২৪ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী সনদ প্রাপ্তি তার দুই দশকের সততা এবং গুণগত মান বজায় রাখার এক আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। এই অর্জনে তার অনুভূতি ছিল অত্যন্ত বিনম্র; তিনি একে কেবল তার একার নয়, বরং সিলেটের আপামর জনতা এবং তার প্রতিটি সহকর্মীর সাফল্য হিসেবে দেখেন।
ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীর লিগ্যাসি বা উত্তরসূরি হিসেবে তার সন্তান তানভীর এমও রহমান চৌধুরী বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পিতার সুযোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তিনি গবেষণা, উদ্ভাবন এবং আন্তর্জাতিক সংযোগের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন। ড. তৌফিক আজ ‘চেয়ারম্যান এমেরিটাস’ হিসেবে নেপথ্যে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছেন, যেন তার স্বপ্নের প্রতিষ্ঠানটি কখনো তার মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়। তার দর্শন অনুযায়ী, একটি আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় কেবল প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত হলে চলে না, তাকে হৃদয়ে ধারণ করতে হয় দেশপ্রেম এবং আর্তমানবতার সেবা। মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা আজ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়ে প্রমাণ করছেন যে, ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী যে বীচটি রোপণ করেছিলেন, তার ফল আজ সমাজকে সুবাসিত করছে।
ড. তৌফিক রহমান চৌধুরীর নেতৃত্ব কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো তার শিক্ষক মণ্ডলী। তাই তিনি সবসময় মেধাবী ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের এই প্রতিষ্ঠানে যুক্ত করতে সচেষ্ট ছিলেন। তার মতে, “একজন ভালো শিক্ষক কেবল পাঠদান করেন না, তিনি শিক্ষার্থীর ভেতরে সুপ্ত থাকা সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলেন।” বর্তমানে ১৩০ জনের বেশি অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি যে এগিয়ে যাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে ড. তৌফিকের সেই শিক্ষক-বান্ধব ও শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক শিক্ষানীতি। তিনি চেয়েছিলেন সিলেটে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে, যাতে এই অঞ্চলের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকামুখী বা বিদেশমুখী হতে না হয়।
মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিকে তিনি কেবল একটি বৈষয়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখেননি, বরং একে সামাজিক পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলেছেন। মেধাবী কিন্তু আর্থিকভাবে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি সবসময় উদার ছিলেন। তার নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীকে বৃত্তি ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করে আসছে। ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী প্রায়ই বলেন, “অর্থের অভাবে কোনো মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বপ্ন যেন থমকে না যায়, সেটা নিশ্চিত করাই আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।” এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি তাকে একজন সাধারণ উদ্যোক্তা থেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তার প্রতিষ্ঠিত ‘সিটিআরপি’র মাধ্যমে সামাজিক বিভিন্ন সমস্যার ওপর গবেষণা পরিচালনা করা হয়, যা পরোক্ষভাবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ভূমিকা রাখে।
প্রযুক্তির এই যুগে শিক্ষার্থীরা যেন পিছিয়ে না থাকে, সেজন্য তিনি শুরু থেকেই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন। সম্প্রতি অনুমোদিত ডাটা সায়েন্স বিভাগটি তার সেই আধুনিক চিন্তাধারারই ফসল। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় গতানুগতিক শিক্ষার বাইরে গিয়ে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ অর্জন করা অপরিহার্য। তিনি শুধু সিলেট বা বাংলাদেশকে নিয়ে ভাবেননি, বরং তার লক্ষ্য ছিল মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েটরা যেন বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে।
ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত বিনয়ী ও মিষ্টভাষী এই মানুষটি প্রতিটি কর্মীর কাছে একজন অভিভাবকের মতো। তার দীর্ঘ সোনালী ব্যাংকের কর্মজীবন তাকে ধৈর্য ও সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার যে ক্ষমতা দিয়েছিল, তা তিনি ঢেলে দিয়েছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্যাণে। ২০২৪ সালে স্থায়ী সনদ অর্জনের মধ্য দিয়ে তার সেই দীর্ঘ সংগ্রামের বিজয় সূচিত হয়েছে। ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী প্রমাণ করেছেন যে, সততা, নিষ্ঠা এবং জনকল্যাণের ব্রত থাকলে একটি সাধারণ প্রতিষ্ঠানকেও বিশ্বমানের শিক্ষালয়ে রূপান্তর করা সম্ভব। তার এই জীবনগল্প আগামীর তরুণদের শেখায় যে, দেশ ও দশের জন্য কিছু করার তৃপ্তি অন্য যেকোনো পার্থিব অর্জনের চেয়ে অনেক বড়।
ড. তৌফিক রহমান চৌধুরী কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেননি, তিনি একটি নতুন স্বপ্নের জন্ম দিয়েছেন। তার জীবন আমাদের শেখায় যে, যদি লক্ষ্য স্থির থাকে এবং হৃদয়ে জনকল্যাণের ইচ্ছা থাকে, তবে শূন্য থেকে শুরু করেও বিশাল কিছু অর্জন সম্ভব। সিলেটের বটেশ্বরের সবুজ ক্যাম্পাসে যখন শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত হয়, তখন সেখানে প্রতিফলিত হয় ড. তৌফিকের সেই অমর বাণী—শিক্ষা কেবল তথ্য আহরণ নয়, বরং সমাজকে আলোকিত করার এক অনন্য শক্তি। তিনি থাকবেন ইতিহাসের পাতায় এবং হাজারো শিক্ষার্থীর হৃদয়ে একজন মহান শিক্ষক ও পথপ্রদর্শক হিসেবে, যিনি শিখিয়েছেন কীভাবে স্বপ্নের সমান বড় হতে হয়।