
“জুলাই ঘোষণাপত্র ঐক্যের প্রতীক হয়ে থাকবে” এমনটাই বিশ্বাস করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এর পেছনে অবশ্য যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে কারণ এই ঘোষণাপত্র নিয়ে সরকার সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। এরপরই খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে এই ঘোষণাপত্রও সব অংশীজনের উপস্থিতিতেই পাঠ করা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পারওয়ার, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, ইসলামী আন্দোলনের আমির মুফতি রেজাউল করিম, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরসহ অন্যরা জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছেন।
এই ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক কারণ এটি ২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় ও সংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়। যা আগামী সংসদ ও নির্বাচনের মাধ্যমে সংশোধিত সংবিধানের একটি নির্ধারিত সূচকে যুক্ত হবে।
নির্বাচনের কথায় মনে পড়লো আগামী রমজানের আগে, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, “নির্বাচনের দিনকে আমরা ঈদের উৎসবের মতো করতে চাই। এবারের ভোটের আনন্দ থাকবে সবার মধ্যে। আপনারা সবাই বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন।”
গত মঙ্গলবার রাতে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবস’ এ জাতির উদ্দেশে ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। অর্থাৎ কিছুদিন পরই আমাদের কাছ থেকে পুরোপুরি বিদায় নিবেন তিনি। তিনি অনেক স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছা নিয়ে এসেছিলেন এই দেশে। এবং সেসবের অনেককিছুই এখনো রয়ে গেছে অপূর্ণ। যদিও তিনি সম্পূর্ণভাবেই এদেশের মানুষের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছেন। তিনি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে চেয়ারে বসার পর থেকে দেশে এ পর্যন্ত ১৭৪ টা আন্দোলন হয়েছে, ভয়াবহ বন্যা হয়েছে, বিমান দূর্ঘটনা হয়েছে, আরও কতশত অযাচিত ঘটনা ঘটেছে। এত শত পারিপার্শ্বিক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেশের রিজার্ভও ৩০ বিলিয়ন হয়েছে ইউনুস সরকারের আমলেই।

শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গঠিত আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচার সরকার উৎখাত হওয়ার পর, তিনি নবগঠিত সরকারের মুখ হিসেবে সংখ্যালঘু ও মানবাধিকারসমূহ রক্ষা, সরকারি স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ছিলেন সচেষ্ট। তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্মেলন আহ্বান করেন এবং তাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থার মনোযোগ আকর্ষণ করেন। দেশের ডিজিটালাইজেশনের জন্য স্টারলিংক এর মাধ্যমে সার্ভার ইন্টারনেট ব্যবস্থা উন্নত করা এবং ইন্টারনেট বন্ধের ঝুঁকি হ্রাসে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চোখের পলকে কিভাবে এক বছর কেটে গেল আমরা যেন বুঝেই উঠতে পারিনি। আবারো যেন বাস্তবতায় ফিরে আসি জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র পঠিত হওয়ার সময়। যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে এই ঘোষণা পত্র। পূর্ববর্তী শাসকদলের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ বিচারের দাবি ও দমনপীড়নের তদন্ত নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা উল্লেখিত আছে এখানে। সংস্কার ও রাজনৈতিক পুনর্গঠন, শিক্ষাগত অধিকার, পরিবেশ, মানবাধিকার, ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি সমাজের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে এই ঘোষণাপত্রে।
যদিও প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণাপত্র পাঠের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমি মনে করি, জুলাইয়ের যে আকাঙ্ক্ষা এই ঘোষণাপত্রে সেটার তেমন কোনো প্রতিফলন হয়নি। একটা পাশ কাটিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আমরা দেখেছি।’
তিনি বলেন, ‘এটা কোন তারিখ থেকে বাস্তবায়ন হবে? কালকে থেকেই বাস্তবায়িত হবে? সেটা কিন্তু স্পষ্ট করেনি। তা ছাড়া আমরা এটাকে সংবিধানে প্রিয়াম্বেলে চেয়েছিলাম, সেটা হয়নি ‘
তিনি বলেন, ‘উনারা যেটা বললেন, আগামী সরকার বাস্তবায়ন করবে। তাহলে বোঝা গেল, এই সরকার কিছু করবে না। অথচ দায়িত্ব হচ্ছে এই সরকারের। এভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ একটা ইস্যুকে হালকাভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার যে ঘোষণাপত্র দেখলাম তাতে আমরা হতাশ। এই জাতি হতাশ।’
এই হতাশা আদৌ দীর্ঘস্থায়ী হয় কিনা এটা অনেকটাই নির্ভর করছে এই ঘোষণাপত্রে উল্লেখিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের ওপর। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পলায়নের প্রথম বর্ষপূর্তির দিনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রকে স্বাগত জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।
গত ৫ আগস্ট বিকেলে ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে সাংবাদিকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ কথা জানান দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। নাহিদ ইসলাম বলেন, “জুলাই ঘোষণাপত্র হয়েছে এটাকে স্বাগত জানাই। ভালোভাবে পড়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। এটা যে হয়েছে সেটাকে অভিনন্দন।”
হ্যাঁ, নাহিদ ইসলামের মত করে আমরাও যথেষ্ট আশাবাদী থাকতে চাইছি এ ঘোষণা পত্র নিয়ে। কারণ ঘোষণাপত্রে জুলাই আন্দোলনে নিহতদের “জাতীয় নায়ক” হিসেবে স্বীকৃতির দাবি করা হয়েছে; পাশাপাশি আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য আইনি সুরক্ষা প্রদানের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এই বিষয়টি যথেষ্ট হৃদয়স্পর্শী এবং দেশপ্রেমীদের প্রতি শ্রদ্ধার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ।
ঘোষণাপত্রে মোট ২৮টি ধারা অন্তর্ভুক্ত, যা রাজনৈতিক, সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার, নির্বাচন ও সরকার ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে । দলীয় শাসন, দুর্নীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো সমস্যা তুলে ধরে, ১৯৭২-এর সংবিধানের পুনঃসমালোচনা ও সংস্কারের অঙ্গীকার করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ রয়েছে: নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, বিচারপতিদের স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার ও পরিবেশ সহিষ্ণু উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ।
এমনকি বিশ্লেষকেরাও মনে করছেন ঘোষণাপত্রটি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে কাজ করবে। এবং সেই সাথে আমাদেরও বারংবার স্মরণ করাবে তাদের কথা, যাদের দেশপ্রেম ও ত্যাগের কারণে আমরা মুক্তি পেয়েছিলাম স্বৈরাচারের থাবা থেকে।
এত আয়োজন, উদ্যোগ এবং তা বাস্তবায়নের মাঝেও আমাদের মনের কোণে কোথাও হয়তো একটি প্রশ্ন উকি দেয়- ‘তাঁরা কি ফিরিবে আজ সুপ্রভাতে যত তরুণ অরুণ গেছে অস্তাচলে?’