রাজু আলীম
সম্পাদক, ইউএসএ বাংলা নিউজ
ড. ফারাহনাজ ফিরোজ বাংলাদেশের বেসরকারি উচ্চশিক্ষা অঙ্গনে এমন এক নাম, যিনি একাধারে একজন বিজ্ঞানী, শিক্ষক, গবেষক, উদ্যোক্তা এবং নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বের প্রতীক। তার যাত্রা শুরু হয়েছিল ভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে, নিউ ইয়র্কে। শৈশব ও কৈশোরের অভিজ্ঞতা তার চিন্তা, আচরণ ও কাজে স্পষ্ট ছাপ রাখে। তিনি যুক্তরাজ্যের Kingston University London–এ Biomedical Sciences নিয়ে উচ্চশিক্ষা পড়াশোনা করেন। পরবর্তীতে জাপানের Kindai University–তে Agricultural Sciences–এ পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এই দীর্ঘ শিক্ষাযাত্রা তাকে শুধু জ্ঞানেই সমৃদ্ধ করেনি; তৈরি করেছে এক বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি যা আজ তার নেতৃত্বে প্রতীয়মান।
পড়াশোনা শেষে ড. ফারাহনাজ ফিরোজ বাংলাদেশে ফিরে এসে তিনি ২০১১ সালে Stamford University Bangladesh–এ শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকেই তার দ্বিতীয় যাত্রা শুরু হয়। ক্লাসরুমে তিনি খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। Microbiology বিভাগের শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি ছিলেন সহজ, প্রাসঙ্গিক, গবেষণানির্ভর এবং সর্বদা আপডেট তথ্য শেখানো একজন শিক্ষক। পর্যায়ক্রমে তিনি বিভাগীয় পর্যায়ের নানা কমিটিতে কাজ করেন। পরে Acting Chairman হিসেবে নেতৃত্ব দেন Microbiology বিভাগকে। একই সময়ে তিনি Student Welfare–এর পরিচালক হন। শিক্ষার্থীর সংকট, পরামর্শ, পরিধি–বহির্ভূত নানা সামাজিক সমস্যার সঙ্গে সমন্বয়ের ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন সফল এবং দক্ষ প্রশাসক।
তার গবেষণার ক্ষেত্র Food Microbiology, Food Safety, Environmental Microbiology–কে কেন্দ্র করে। তিনি দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন বাংলাদেশের বাজারে পাওয়া সবজি, ফল, মাংস, মাছ ও পানির মাইক্রোবায়োলজিক্যাল নিরাপত্তা নিয়ে। তার গবেষণা প্রবন্ধগুলোতে উঠে এসেছে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, খাদ্যে রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি, দূষিত পানি ব্যবহারের ঝুঁকি, সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের সহজ ও সাশ্রয়ী পদ্ধতি। এই গবেষণা শুধু ল্যাবরেটরিতে সীমাবদ্ধ নয়; এগুলো জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত। সাধারণ ভোক্তার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি কমাতে তার গবেষণা বাস্তবসম্মত সমাধানও দিয়েছে। তাই তার প্রকাশিত ২০টির বেশি রিসার্চ পেপার শুধু একাডেমিক অর্জন নয়; বরং জনস্বাস্থ্যে অনন্য অবদান।
Stamford University–র বোর্ড অফ ট্রাস্টিজে তিনি যুক্ত ছিলেন ২০১১ সাল থেকেই। এই দীর্ঘ সম্পৃক্ততা তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ট্রাকচার, নীতি, চ্যালেঞ্জ, উন্নয়ন—সবদিক বুঝতে সাহায্য করেছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তিনি বোর্ড অফ ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। একজন বিজ্ঞানী ও গবেষক যখন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে আসেন, তখন শিক্ষা পরিচালনায় গবেষণা–মনস্কতা ও গুণগত পরিবর্তন আনার সুযোগও বাড়ে। তার ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা আরও দৃশ্যমান। কারণ তিনি একদিকে আধুনিক শিক্ষার কাঠামো সম্পর্কে সুগভীর ধারণা রাখেন, অন্যদিকে শিক্ষা–ব্যবস্থাপনার জটিল বাস্তবতা নিয়েও কাজ করার অভিজ্ঞতা রাখেন।
তার নেতৃত্ব এমন সময়ে এসেছে যখন বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাত নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। মানোন্নয়ন, গবেষণা তহবিল, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, শিক্ষার্থীর দক্ষতা উন্নয়ন—এসব বিষয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। ড. ফারাহনাজ ফিরোজের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা তাকে এই পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ন নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি ছাত্র–শিক্ষক সম্পর্ক, একাডেমিক মান, গবেষণা–সুযোগ বৃদ্ধির বিষয়গুলোকে নতুনভাবে সাজাতে আগ্রহী। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক সুশাসন, ডিজিটাল রূপান্তর এবং গবেষণাগার উন্নয়নে তার গুরুত্ব অব্যাহত রয়েছে।
একাডেমিক দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি উদ্যোক্তা হিসেবেও কাজ করছেন। Stamford Foods and Agro Ltd.–র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে তিনি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কৃষি–উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তি ও সুরক্ষা–মান নিশ্চিত করার কাজ করছেন। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে তার গবেষণার অভিজ্ঞতা তাকে উদ্যোক্তা পর্যায়েও দায়িত্ববান করেছে। শুধু শিল্প নয়, তিনি Penny and Peter’s Playland প্রতিষ্ঠা করেছেন, যা শিশুদের জন্য এক সৃজনশীল শেখার পরিবেশ। “Penny and Peter” নামে শিশুদের জন্য তিনি বইও প্রকাশ করেছেন। এই কাজগুলো প্রমাণ করে শিশু–বিকাশ, সৃজনশীলতা ও নিরাপদ পরিবেশ গঠনে তার মনোযোগ কতটা গভীর।
২০২৫ সালে তিনি JCI Dhaka Heritage–এর স্থানীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। যুব নেতৃত্বের প্ল্যাটফর্মে তার সক্রিয়তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়; সমাজের বৃহত্তর পরিসরেও তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে তার ভাবনার প্রতিফলন। যুবদের সমাজসেবা, উদ্যোগ, নেতৃত্ব ও নৈতিকতায় ভূমিকা বাড়াতে তিনি কাজ করছেন। একজন শিক্ষাবিদ যখন যুব প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হন, তখন শিক্ষা ও সামাজিক দায়িত্ববোধের মধ্যে একটি কার্যকর সেতুবন্ধন তৈরি হয়। তার কার্যক্রমে সেই সেতুবন্ধন স্পষ্ট।
সাম্প্রতিক সময়ে তাকে নিয়ে আলোচনার মূল কারণ তার নেতৃত্ব–দক্ষতা, আচরণগত পরিমিতি এবং প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ সহজ ও স্বচ্ছ। সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি সমন্বয় ও সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখেন।
তার ব্যক্তিত্বের বড় বৈশিষ্ট্য—কাজের ক্ষেত্রে ধারাবাহিকতা। একজন নারী নেতৃত্ব হিসেবে তার অবস্থান বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃত্বে নারীর সংখ্যা এখনও কম। ড. ফিরোজ সেই জায়গায় একটি উদাহরণ। তিনি দেখিয়েছেন সক্ষমতা, প্রতিশ্রুতি, পরিশ্রম ও নৈতিক দায়িত্ববোধ থাকলে নেতৃত্ব লিঙ্গনির্ভর নয়। বাংলাদেশে নারী নেতৃত্বকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে তার উপস্থিতি একটি ইতিবাচক বার্তা।
আজ তিনি একসঙ্গে বহু কাজে যুক্ত। গবেষণা করছেন। শিক্ষকতা করছেন। প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মসংস্থান তৈরি করছেন। সামাজিক ও যুব সংগঠনে সক্রিয়। এই বহুমুখিতা বিরল। কিন্তু তার বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা, ব্যক্তিগত স্থিরতা এবং কাজের প্রতি আন্তরিকতা তাকে এই সব ক্ষেত্রেই এগিয়ে নিয়েছে।
বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশগত ঝুঁকি বাড়ছে। একই সময়ে উচ্চশিক্ষা খাতে রূপান্তরের চাহিদা বাড়ছে। যুবদের মানসম্মত শিক্ষা, দক্ষতা, নৈতিকতা ও নেতৃত্ব গঠনের প্রয়োজনও স্পষ্ট। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড. ফারাহনাজ ফিরোজ এমন একজন ব্যক্তি, যিনি এই সব ক্ষেত্রেই বাস্তবসম্মত অবদান রেখে চলছেন। তার কাজের পরিধি ও প্রভাব ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলেই অনুমান করা যায়।
তার জীবন, শিক্ষা, নেতৃত্ব ও কর্মপ্রচেষ্টা মিলিয়ে একটি স্পষ্ট চিত্র পাওয়া যায়—তিনি শুধু নিজের ক্যারিয়ার গড়ছেন না; তিনি একটি প্রজন্মকে গড়ে তোলার দায়িত্ব নিয়েছেন। তার গবেষণা জনস্বাস্থ্যে উপকারী। তার একাডেমিক ভূমিকা শিক্ষার্থীদের মান উন্নত করছে। তার নেতৃত্ব একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে সহায়ক। তার সামাজিক ও সাংগঠনিক কাজ তরুণদের নতুনভাবে ভাবতে শেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে তিনি আজ বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য–উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিনত হয়েছেন।
এ কারণেই ড. ফারাহনাজ ফিরোজ শুধু একজন শিক্ষক নন। তিনি একজন চিন্তাশীল গবেষক, দায়িত্বশীল প্রশাসক, সচেতন উদ্যোক্তা এবং ভবিষ্যতের জন্য আশাব্যঞ্জক নেতৃত্ব। তিনি দেখিয়েছেন জ্ঞান, সততা, সৃজনশীলতা এবং সামাজিক দায়িত্ববোধ মিললে একজন মানুষ কত বড় প্রভাব রাখতে পারেন।
ড. ফারাহনাজ ফিরোজ স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলার সময় বলেন, এই দিনটি শুধু শিক্ষাগত সাফল্যের উদযাপন নয়। এটি শিক্ষার্থীদের কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং নিষ্ঠারও উদযাপন। তিনি জানান, শিক্ষার্থীরা যে পথ পাড়ি দিয়ে এখানে পৌঁছেছে, তা সহজ ছিল না; অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয়েছে। আজকের দিন তাদের পরবর্তী জীবনের শুরু, সেই সঙ্গে তাদের অর্জিত সাফল্যের মুহূর্তও।
তিনি শিক্ষার্থীদের মনে করিয়ে দেন , নতুন চ্যালেঞ্জ আসবেই। এগুলো তাদের দৃঢ়তা, মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা এবং সাহসিকতা পরীক্ষা করবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শিক্ষা ও দক্ষতা তারা অর্জন করেছে, এবং যে বন্ধুবান্ধব ও নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে, তা সামনে আসা পরিস্থিতিতে খুব কাজে লাগবে। ড. ফিরোজ বলেন, স্নাতক হয়ে শিক্ষার্থীরা এখন একটি গর্বিত ঐতিহ্যের অংশ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীদেরও ধন্যবাদ জানান, যারা এই অনুষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের সাফল্যের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন।
ড. ফিরোজ আরও বলেন, যখন শিক্ষার্থীরা বাইরে বৃহত্তর জগতে প্রবেশ করবে, তখন তাদের এমন মানুষের সঙ্গে থাকা উচিত, যারা নতুন দৃষ্টিকোণ দেখাবে, চ্যালেঞ্জ জানাবে এবং তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের বাইরে গিয়ে অনুপ্রেরণা দেবে। তিনি মনে করিয়ে দেন, বর্তমান বিশ্বের চ্যালেঞ্জ আগের সময়ের মতো নয়। তাই শিক্ষার্থীদের নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে, নিজেদের দক্ষতা ব্যবহার করতে হবে এবং বিশ্বের পরিবর্তন আনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সাহসী হতে হবে, মানিয়ে নিতে জানতে হবে এবং নতুন ভাবনায় এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার্থীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে যারা সাহায্য করেছে—পরামর্শদাতা, শিক্ষক, পরিবার ও বন্ধু—তাদের কখনো ভুলে যাওয়া উচিত নয়। শেষ পর্যন্ত তিনি শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা জানিয়ে বলেন, তিনি গর্বিত এবং এই মুহূর্তটি উপভোগ করেছেন। শিক্ষার্থীরাই তার কাজকে আরও ভালো করতে অনুপ্রাণিত করে।
ড. ফারাহনাজ ফিরোজের ব্যক্তিত্ব ও নেতৃত্বের মূল বৈশিষ্ট্য হলো মানবিকতা, স্থিরতা এবং দায়িত্ববোধ। তিনি কোনো কাজকে শুধু পেশাগত দায়িত্ব হিসেবে দেখেন না; বরং তার প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে থাকে পরিকল্পনার ছাপ।শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে শুধু শিক্ষকের জায়গা থেকে নয়, বরং একজন গাইড, পরামর্শদাতা এবং সহমর্মী হিসেবে।
ড. ফিরোজের নেতৃত্ব কেবল প্রশাসনিক বা গবেষণাগত নয়, এটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন। তার গবেষণা খাদ্য নিরাপত্তা ও পরিবেশ সচেতনতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। উদ্যোক্তা হিসেবেও তিনি সমাজের প্রয়োজন অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। তার স্থির, নির্ভীক এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিত্ব শিক্ষার্থীদের জন্য উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। তার জীবন ও কাজ প্রমাণ করে, একজন ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজের সাফল্য অর্জন করতে পারে না; বরং সমাজ, শিক্ষার্থী এবং প্রজন্মের জন্য প্রভাব তৈরি করাই সত্যিকারের নেতৃত্ব।