রাজু আলীম
সম্পাদক, ইউএসএ বাংলা নিউজ
জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নতুন করে আলোচনায় এসেছে। এই আন্দোলনের বড় একটি অংশ ছিল শিক্ষার্থী ও তরুণদের অংশগ্রহণ, যাদের দীর্ঘদিনের হতাশা এই সময়ে প্রকাশ পায়। পড়াশোনা শেষ করেও চাকরি না পাওয়া, দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন—এই বিষয়গুলোই তাদের ক্ষোভের মূল কারণ হয়ে উঠেছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বাস্তব চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না।
এই প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরীর অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ হিসেবে মনে করেন, শিক্ষা সংকট কেবল একটি খাতের সমস্যা নয়, এটি ভবিষ্যৎ অর্থনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গেও জড়িত। অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) উপাচার্য ও গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তিনি প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ও ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। আবদুল হান্নান চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের নর্থ ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি এবং অপারেশনস রিসার্চে এমএস ডিগ্রি অর্জন করেন। এছাড়া তিনি কানাডার ক্যালগারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ফেলোশিপ করেছেন। তাঁর মতে, শিক্ষা ব্যবস্থার মান উন্নয়ন, যোগ্য শিক্ষক তৈরি এবং বাস্তবমুখী কারিকুলাম ছাড়া তরুণদের সামনে নতুন সম্ভাবনা খুলে দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁর বক্তব্য বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।
অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী এই সংকটের মূল কারণ হিসেবে শিক্ষক সংকট এবং নীতিগত দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষা সম্ভব নয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক নিয়োগ, প্রশিক্ষণ এবং মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে মেধার বদলে অন্যান্য বিবেচনায় নিয়োগ হয়েছে, যা শিক্ষা ব্যবস্থার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একই সঙ্গে গবেষণা ও উদ্ভাবনের পরিবেশ গড়ে না ওঠায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান উৎপাদনের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখলে চলবে না। এটি সরাসরি অর্থনীতি, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে যুক্ত। যখন একজন তরুণ শিক্ষাজীবন শেষ করে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভোগে, তখন তার প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রের ওপরও চাপ তৈরি করে। জুলাইয়ের অভ্যুত্থান সেই জমে থাকা চাপেরই প্রকাশ।
এই বাস্তবতায় শিক্ষা সংস্কার এখন আর বিলাসিতা নয়, বরং সময়ের দাবি। কারিকুলামকে বাস্তবমুখী করা, শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরীর বক্তব্য আমাদের সেই বাস্তবতার দিকেই আবারও চোখ ফেরাতে সাহায্য করে।
জুলাইয়ের অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে যখন একের পর এক কমিশন গঠনের আলোচনা চলছে, তখন শিক্ষা খাতের সংস্কার প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল। কারণ এই অভ্যুত্থান ছিল মূলত তরুণদের দ্বারা পরিচালিত, আর সেই তরুণদের ক্ষোভের বড় জায়গাটি ছিল শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যকার ভয়াবহ বিচ্ছিন্নতা। অধ্যাপক ড. আবদুল হান্নান চৌধুরীর মতে, শিক্ষিত হয়েও যোগ্য চাকরির সুযোগ না পাওয়া এবং নিজের অর্জিত জ্ঞান যে বৈশ্বিক মানে পৌঁছায়নি, এই উপলব্ধিই তরুণদের মধ্যে বঞ্চনার বোধ তৈরি করেছে। দীর্ঘদিন শিক্ষাঙ্গনে থাকা একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন, স্বাধীন ও শক্তিশালী একটি হায়ার এডুকেশন কমিশনের মাধ্যমে শিক্ষা ও গবেষণাকে একটি কাঠামোবদ্ধ পথে এগিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, ইউজিসি বা অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সহায়ক ভূমিকার চেয়ে নিয়ন্ত্রণমূলক প্রশাসনে বেশি মনোযোগী, ফলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন এখনও অধরাই রয়ে গেছে।
গত দেড় দশকে শিক্ষার মান নিয়ে যে বড় প্রশ্ন উঠেছিল, অভ্যুত্থানের পরেও তার কোনো মৌলিক উত্তরণ হয়নি। ড. হান্নান স্পষ্ট করে বলেন, বাংলাদেশ তার ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুবিধা নিতে পারেনি। প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী দ্বাদশ শ্রেণি শেষ করলেও তাদের উচ্চশিক্ষার সঠিক ধারায় আনা যাচ্ছে না। যাদের আনা হচ্ছে, তাদেরও বৈশ্বিক মানের দক্ষতা বা চিন্তাশক্তি গড়ে উঠছে না। বিশ্বব্যাংকের তথ্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের একজন দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীর দক্ষতা বৈশ্বিক মানের তুলনায় অনেক নিচে। আমরা প্রায়ই বলি, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিদেশে গিয়ে ভালো করছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তারা ভালো করছে প্রতিষ্ঠান বা সিস্টেমের কারণে নয়, নিজেদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও আত্মসংগ্রামের মাধ্যমে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনতা, নমনীয়তা ও ফোকাস দিতে ব্যর্থ হয়েছে, আর এই ব্যর্থতার শুরুটা হয়েছে একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে।
শিশুদের শেখানোর ক্ষেত্রে আমরা নৈতিকতা, মূল্যবোধ, খেলাধুলা কিংবা অনুসন্ধিৎসার জায়গা তৈরি না করে মুখস্থবিদ্যার ওপর জোর দিয়েছি। এর ফল হিসেবে তৈরি হয়েছে সার্টিফিকেটধারী কিন্তু চিন্তাশূন্য একটি প্রজন্ম। ড. হান্নানের ভাষায়, এটি কোনো একক উপাদানের ব্যর্থতা নয়; এটি একটি সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেমের ভাঙন। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়—সব স্তরেই যোগ্য ও উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। তিনি কঠোর ভাষায় বলেন, অযোগ্য শিক্ষক জাতির জন্য বোঝা। শিক্ষার গুণগত মানের চেয়ে সংখ্যার দিকে নজর দেওয়ার ফলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন মূলত ডিগ্রি ও সনদের কারখানায় পরিণত হয়েছে, যেখানে বিশ্লেষণী ক্ষমতা বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা তৈরি হয় না।
এই সংকটের আরেকটি বড় দিক হলো মাদ্রাসা শিক্ষার সঙ্গে মূলধারার বিচ্ছিন্নতা। সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে ম্যাট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েটের সমতুল্য স্বীকৃতি দিলেও সেই মানের জ্ঞান অর্জনের নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি ভাষা, গণিত ও বিজ্ঞান শেখানোর মাধ্যমে যদি সমন্বয় করা যেত, তাহলে শিক্ষার্থীরা সমাজ ও কর্মজীবনের জন্য অনেক বেশি প্রস্তুত হতো। কিন্তু সেই কাঠামোগত সংস্কার হয়নি। একইভাবে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনো কঠোর গণ্ডিতে আবদ্ধ। জীববিজ্ঞান না পড়লে ডাক্তার হওয়া যাবে না, গণিত না পড়লে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যাবে না, এই প্রথাগত দেয়াল ভাঙার প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি জোর দেন। উন্নত বিশ্বে লিবারেল আর্টসের শিক্ষার্থীরাও মেডিকেলে পড়ার সুযোগ পায়, কারণ আধুনিক চিকিৎসা ও প্রযুক্তি এখন বহুমাত্রিক জ্ঞানের ওপর দাঁড়িয়ে।
ড. হান্নান মনে করেন, শিক্ষার প্রতিটি স্তরকে আন্তঃসম্পর্কিত হতে হবে। কেবল নম্বর দিয়ে মেধা যাচাই না করে শিক্ষার্থীদের এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে যাওয়ার স্বাধীনতা দিতে হবে। এতে যেকোনো ব্যাকগ্রাউন্ডের মেধাবী শিক্ষার্থী তার পছন্দের উচ্চতর বিদ্যায় অবদান রাখতে পারবে। কিন্তু এই পরিবর্তন আনতে হলে বাজেটের প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, শিক্ষা খাতে জিডিপির ছয় শতাংশ বরাদ্দ দেওয়ার বৈশ্বিক মানদণ্ডের বিপরীতে বাংলাদেশ এখনো দুই থেকে আড়াই শতাংশে আটকে আছে। এটি কোনো এক বছরের সমস্যা নয়; এর জন্য বিশ থেকে ত্রিশ বছরের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রয়োজন। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময়সীমা সীমিত, আর এই সময়ের মধ্যে বিনিয়োগ না করলে সেই জনশক্তিই ভবিষ্যতে সামাজিক বোঝায় পরিণত হবে।
সমাজে যে অস্থিরতা, সহিংসতা ও হতাশা দেখা যাচ্ছে, সেটিকেও তিনি গত দুই দশকের শিক্ষা ও রাষ্ট্রচিন্তার ফল বলে মনে করেন। আজ যে তরুণ রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করছে, সে এমন একটি বাংলাদেশ দেখেছে যেখানে রাষ্ট্র একটি নির্দিষ্ট ন্যারেটিভ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। মেধা ও যোগ্যতার বদলে পরিচয় ও আনুগত্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ড. হান্নানের মতে, কোনো দর্শন বা আদর্শ জোর করে চাপিয়ে দিলে তার ফল উল্টো হয়, আর বাংলাদেশে সেটাই হয়েছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও প্রযুক্তির প্রসঙ্গে তিনি বাস্তববাদী অবস্থান নেন। এআইকে শুধু কোডিং শেখার বিষয় হিসেবে নয়, স্বাস্থ্য, ব্যবসা ও সামাজিক সমস্যার সমাধানে ব্যবহার করার ওপর গুরুত্ব দেন। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টেলিজেন্স মেশিন ল্যাব, সাইবার সিকিউরিটি ক্লিনিক, ফ্যাব ল্যাব ও ইনোভেশন হাব গড়ে তোলার উদ্দেশ্যও তাই—বিশ্ববিদ্যালয় যেন কেবল গবেষণাপত্র প্রকাশে সীমাবদ্ধ না থেকে সরাসরি সমাজের সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখে।
ইউজিসি ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার ভূমিকা নিয়েও তার স্পষ্ট মত আছে। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে একই মানদণ্ডে বিচার করা অবাস্তব। নতুন ও পুরোনো প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা এক নয়। উন্নত বিশ্বের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্যাটাগরি অনুযায়ী স্বাধীনতা দিতে হবে। সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দীর্ঘমেয়াদে কাজ করার সুযোগ দিলে তার ফলাফলই মানের প্রমাণ দেবে। অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বকীয়তা ধ্বংস করে।
গবেষণা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও তিনি আশাবাদী উদাহরণ তুলে ধরেন। বিদেশি ফান্ডিং, আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা, এআই ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে স্বাস্থ্য ও নগর সমস্যার সমাধান—এসবই প্রমাণ করে যে সঠিক দিকনির্দেশনা পেলে বাংলাদেশেও বিশ্বমানের কাজ সম্ভব। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে বিদেশফেরত স্কলারদের জন্য রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানকে আরও স্বাগতশীল হতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জটিল কাঠামো এখনো সেই পথে বড় বাধা।
ড. আবদুল হান্নান চৌধুরী সবশেষে আশাবাদী মানুষের কথাই বলেন। তিনি বিশ্বাস করেন, দেশের তরুণ ও শিক্ষকদের মধ্যে এখনও অপার সম্ভাবনা আছে। শুধু তাদের হাত-পা বেঁধে না রেখে সিস্টেমের জটগুলো খুলে দিতে হবে। কোনো মেধাবী শিক্ষার্থী যদি দ্রুত এগোতে পারে, তাকে আটকে রাখা যাবে না। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা—শুধু দালানকোঠা বানালেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয় না। উপযুক্ত শিক্ষক, সঠিক প্রশিক্ষণ ও স্বাধীন চিন্তার পরিবেশ না থাকলে শিক্ষা নয়, তৈরি হয় কেবল সনদ। আর ভুল শিক্ষা জাতির জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতি।