
বৃহস্পতিবার সকাল। খবরের খোঁজে দৈনিক সমকালের পাতা উল্টাতে গিয়েই একটি সংবাদ চোখে পড়লো। সংবাদটি একটি সদ্যোজাত শিশুর। একটি নিরুপায় দম্পতির। একটি করুণ বাস্তবতা এবং বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার।
ঘটনার শুরু ১৮ জুলাই। চট্টগ্রাম নগরীর ওআর নিজাম রোডের এশিয়ান স্পেশালাইজড লিমিটেডে স্ত্রীকে ভর্তি করান রাঙ্গুনিয়া উপজেলার এক সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক। সেদিন রাতে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে জন্ম হয় একটি কন্যা সন্তানের। জন্মের পর থেকে শিশুটিকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) রাখা হয়।
এ সময় তাদের বিল আসে ৪৬ হাজার টাকা। অনেক কষ্টে ৪০ হাজার টাকা পরিশোধ করলেও বাদবাকি টাকা দিতে না পেরে সদ্যোজাত শিশু সন্তানটিকে হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান সেই দম্পতি। তাদের খুঁজে না পেয়ে কর্তৃপক্ষ পুলিশের দ্বারস্ত হলে মা-বাবাকে খুঁজে বের করে পুলিশ। বুধবার (৬ আগস্ট) মায়ের হাতে শিশুকে তুলে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এ সময় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি।
উল্লেখ্য, ২২ জুলাই থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে এনআইসিইউ এ বিল আসে তিন লাখ তিন হাজার টাকা। এ ঘটনার পর যার পুরোটাই মওকুফ করে হাসপাতাল কতৃপক্ষ। হাসপাতালের কতৃপক্ষ জানায় গরীব রোগীদের বিলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ছাড় দেওয়া হয়। শিশুটির অভিভাবকরা জানালে আগেই তাদের বিল মওকুফ করে দেওয়া হতো।
তবে, পরিস্থিতির মুখে হয়তো অসহায় সেই দম্পতি সাহস করে অর্থ মওকুফের কথাটিও বলতে পারেনি। চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালে সদ্যোজাত সন্তান রেখে চলে যাওয়া এই দম্পতির ঘটনা শুধুমাত্র একটি মানবিক ট্র্যাজেডি নয়। এটি বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের গভীর সংকট, বৈষম্য এবং বাণিজ্যিক প্রবণতার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ঘটনাটি খুব বেশি ব্যতিক্রমী নয়; বরং এটি বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতের বেদনাদায়ক বাস্তবতার প্রতিফলন।
উল্লেখ করা যেতে পারে,আমি একজন ডাক্তার এর সন্তান। ছোটোবেলায় আমার ভোর বেলায় খুব একটা বাড়িতে দেখতাম না ।তিনি দুর দূরান্তে গ্রামে গ্রামে জেতেন রোগী দেখতে ।বর্ষাকালে লোকেরাই আব্বাকে নৌকা করে নিয়ে যেতেন রোগির আত্মীয়রা ।আমাদের ও নিজেদের নৌকা , কোসা নৌকা ছিলো,কাজের লোকরা আব্বাকে নিয়ে যেতেন।
অনেক গরীব রোগির আত্মীয়রা টাকা পয়সা তেমন দিতে পারতেন না ।আব্বাও তেমন চাপ দিতেন না , টাকার জন্য ।বলতেন রোগী ভালো হলে দিয়েন ,না পারলে নাই ।আমার আব্বা ডাক্তার আবদুল আজিজ এতই মানবদরদী ছিলেন সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মতো না ।
রোগী ভালো হলে দেখতাম বাড়িতে কেউ ,ছাগল -খাশি,মুরগি ,লাউ তরি তরকারি নিয়ে আসতো।সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা।শরীয়তপুর এর কীর্তিনাশার পারে আমার বাড়ি । আব্বাকে অনেক দূরের মানুষ চিনতেন ,ডাক্তার বলে । আমি গর্বিত এমন বাবার সন্তান বলে ! যাই হোক ডাক্তার এর ছেলে বলেই হয়তো এই মর্মান্তিক ঘটনাটার সংবাদটা আমার চোখে পড়লো।
যাই হোক আবার আসি অন্য় প্রসঙ্গে ,দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামো, জনবল এবং সেবার মান প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় মধ্যম এমনকি স্বল্প আয়ের মানুষদের একটি বড় অংশ চিকিৎসার জন্য বেসরকারি খাতের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু এখানে চিকিৎসা যেন এক প্রকার পণ্যে রূপ নিয়েছে, যেখানে মানবিকতা নয়, আগে বিবেচ্য হয় রোগীর পকেট। চট্টগ্রামের এই ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, সামান্য চিকিৎসা সেবাও কতটা অসম্ভব হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের জন্য। একজন বাবা, যিনি প্রতিদিন সিএনজি চালিয়ে আয় করেন, তিনি কি করে একসঙ্গে তিন লাখ টাকা জোগাড় করবেন? এখানে প্রশ্ন শুধু হাসপাতালের নয়, বরং একটি বৃহৎ স্বাস্থ্যনীতির ব্যর্থতার।
এই পরিস্থিতি একটি গভীর সামাজিক অসাম্যও তুলে ধরে। প্রশ্ন করা যায়, চিকিৎসা পাওয়া কি একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার নয়? সংবিধান স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াকে নিশ্চিত করলেও বাস্তবে তা শুধুই কাগুজে নীতির স্তরে সীমাবদ্ধ। বেসরকারি হাসপাতালগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতোই পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে প্রতিটি সেবা ওয়ার্ড, প্রতিটি ইনজেকশন, প্রতিটি শয্যা সবকিছুর আলাদা খরচ। এমনকি নবজাতককে আইসিইউতে, এনআইসিইউতে রাখার দিনপ্রতি চার্জও চলে যায় হাজার হাজার টাকায়। সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে চিকিৎসা শুধু বেঁচে থাকার লড়াই নয়, হয়ে দাঁড়ায় অর্থনৈতিক সহ্যক্ষমতার পরীক্ষাও।
এখানে আরো একটি দিক উঠে আসে। গরিব মানুষের নীরবতা। ঘটনাটির সবচেয়ে করুণ দিক হলো, মা সন্তানকে ফেলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন, তবু তিনি কাউকে কিছু বলেননি। বলতে পারেননি। কারণ সমাজ, রাষ্ট্র, এমনকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, কেউই তাকে একটি বিকল্প বা আশ্বাস দেয়নি। হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দাবি করেছেন, অভিভাবকরা আগে জানালে বিল মওকুফ করে দেওয়া হতো। কিন্তু এমন বক্তব্যও কি একধরনের দায় এড়ানোর কৌশল নয়? প্রশ্ন হচ্ছে, এমন গরিব রোগীর জন্য হাসপাতালের কি কোনো সরাসরি সহায়তা বা সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই? শুধু বিল চাওয়াই কর্তব্য, নাকি স্বপ্রণোদিতভাবে একধরনের মানবিক অনুধাবনও থাকা উচিত ছিল?
বাংলাদেশে চিকিৎসা এখন কার্যত শ্রেণিভিত্তিক হয়ে পড়েছে। উচ্চবিত্তরা বিদেশে যান বা বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নেন; মধ্যবিত্তরা ধার-দেনা করে বাঁচার চেষ্টা করেন; আর গরিবরা হয়তো সন্তানকেই ফেলে রেখে পালিয়ে যান। এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি মানবিক বিভাজনের এক নির্মম চিত্র। একদিকে বিলাসবহুল হাসপাতাল, আধুনিক যন্ত্রপাতি, দামী ডাক্তারের পদচারণা—অন্যদিকে শ্বাসরুদ্ধ গরিব মানুষের অসহায় কান্না, সন্তান হারানোর যন্ত্রণা।
এমন বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠে, দেশের স্বাস্থ্যসেবা কি কেবলমাত্র ধনীদের জন্য? রাষ্ট্র কি কোনো দায়িত্ব নেয়নি এইসব মানুষের প্রতি? সরকারি স্বাস্থ্য খাতের দুর্বলতা, অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসকদের অবহেলা এবং ওষুধের সংকটের কারণে মানুষ বাধ্য হয় বেসরকারি হাসপাতালে আসতে। কিন্তু এখানেও তারা পান এক নিঃসঙ্গ যুদ্ধের বাস্তবতা! যেখানে টাকা না থাকলে চিকিৎসা থেমে যায়, জীবন থেমে যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ মোট জাতীয় বাজেটের তুলনায় নগণ্য। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ছিলো মাত্র ৫.৪ শতাংশ, যা একদিকে প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, অন্যদিকে দুর্নীতি ও অপচয়ের কারণে তা মানুষের কাছে পৌঁছায়ও না। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতে চিকিৎসার দায়ভার বাড়লেও, তা ন্যায্য ও মানবিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে না। দেশজুড়ে হাসপাতাল ব্যবসা হিসেবে গড়ে উঠেছে। যেখানে প্রতিযোগিতা মানেই প্যাকেজ বানিজ্য, বিজ্ঞাপন, সার্ভিস চার্জ এবং লাভের হিসাব। অথচ চিকিৎসাখাত একটি জনকল্যাণমূলক সেবা হওয়া উচিত ছিল, যেখানে জীবন রক্ষার দায়িত্ব সবচেয়ে আগে বিবেচিত হতো।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য নীতিনির্ধারকদের দায়িত্বশীল হতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর আওতায় আনতে হবে, যেখানে নির্দিষ্ট হারে ভর্তির ফি, আইসিইউ চার্জ এবং দরিদ্র রোগীদের জন্য কোটা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়াতে হবে, চিকিৎসকদের পেশাদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে, এবং গ্রামীণ জনপদেও উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে হবে। চিকিৎসা খাতে এনজিও, দাতব্য সংস্থা এবং কর্পোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতার (CSR) ভূমিকা আরো সুসংহত করা যেতে পারে। একইসঙ্গে দরিদ্র রোগীদের জন্য একটি নির্দিষ্ট তহবিল গঠন করে, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তা পরিচালনা করা জরুরি।
চট্টগ্রামের এই ঘটনা আমাদের চোখে জল আনে, কিন্তু একই সঙ্গে একটি বড় প্রশ্নও সামনে এনে দেয়। এই দেশে গরিব মানুষের চিকিৎসা কি শুধুই সহানুভূতির ওপর নির্ভরশীল থাকবে? রাষ্ট্র, সমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এমন এক ব্যবস্থার দিকে এগোনো, যেখানে আর কোনো মা-কে সন্তান রেখে পালাতে না হয়। চিকিৎসা যেন আর শুধু বিলের অঙ্ক না হয়, হয়ে উঠুক একটি মৌলিক অধিকার সবার জন্য, সমানভাবে।