রাজু আলীম
সম্পাদক, ইউএসএ বাংলা নিউজ
![]()
মিস ইউনিভার্স ২০২৫-এর জমকালো আসর থেকে সদ্য দেশে ফিরেছেন বাংলাদেশের প্রতিনিধি তানজিয়া জামান মিথিলা। থাইল্যান্ডের ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এই আসরে বাংলাদেশের হয়ে তিনি যে ইতিহাস গড়েছেন, তা দেশের শোবিজ অঙ্গনের জন্য এক নতুন মাইলফলক। বিশ্বের ১২২টি দেশের প্রতিযোগীদের মধ্যে নিজেকে সেরা ৩০-এ নিয়ে যাওয়া এবং ‘পিপলস চয়েস’ ভোটিংয়ে সেরা ৫-এ অবস্থান করে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, আত্মবিশ্বাস ও সঠিক প্রস্তুতি থাকলে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করা সম্ভব। দেশে ফেরার পর চ্যানেল আই-এর জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘তারকাকথন’-এ অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়ে মিথিলা তার এই রোমাঞ্চকর যাত্রা, প্রাপ্তি এবং সমালোচনার জবাব নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন।
ব্যাংককের সেই বিশ্বমঞ্চে নিজের নাম এবং ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি উচ্চারিত হতে শোনার অনুভূতি মিথিলার কাছে ছিল স্বপ্নের মতো। তারকাকথনে তিনি জানান, যখন তিনি সেরা ৩০-এর তালিকায় নিজের নাম শোনেন, তখন তার মনে হচ্ছিল এই অর্জন শুধু তার একার নয়, বরং পুরো বাংলাদেশের। বিশেষ করে ভোটিং পর্বে দেশের মানুষের যে অভূতপূর্ব সাড়া তিনি পেয়েছেন, তা তাকে আবেগাপ্লুত করেছে। ২১ লাখেরও বেশি ভোট পেয়ে বিশ্বের তাবড় প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে তিনি যখন শীর্ষ তালিকায় জায়গা করে নেন, তখন তিনি বুঝতে পারেন যে দেশের মানুষ তাকে কতটা ভালোবাসে। মিথিলা বলেন, এই ভালোবাসা ও সমর্থনই ছিল তার মূল শক্তি, যা তাকে বিদেশের মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।
তবে এই যাত্রাপথ যে কণ্টকমুক্ত ছিল না, সে কথাও অনুষ্ঠানে অকপটে স্বীকার করেছেন মিথিলা। তারকাকথনের সঞ্চালকের প্রশ্নের জবাবে তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে নিয়ে হওয়া ট্রল ও সমালোচনার জবাব দেন। মিথিলা বলেন, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার আগে এবং চলাকালীন সময়ে তার পোশাক ও অতীত নিয়ে অনেকেই নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। কিন্তু তিনি এসব সমালোচনায় কান না দিয়ে নিজের লক্ষ্যে অবিচল ছিলেন। তার মতে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে একটি দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে হলে সাহস ও ব্যক্তিত্বের প্রয়োজন হয়, যা তিনি তার পারফরম্যান্সের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তিনি সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন, ঘরে বসে নেতিবাচক কথা বলা সহজ, কিন্তু বিশ্বমঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশের পতাকা বহন করার জন্য যে পরিশ্রম ও মানসিক শক্তির প্রয়োজন, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানেন।
অনুষ্ঠানে মিথিলা আরও উল্লেখ করেন যে, তার এই সাফল্য আগামী প্রজন্মের মডেলদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। তিনি বিশ্বাস করেন, তার এই অর্জন প্রমাণ করেছে যে বাংলাদেশের নারীরাও আন্তর্জাতিক সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় নিজেদের মেধা ও সৌন্দর্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম। মা এবং পরিবারের সমর্থনের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন এবং বলেন যে তার মায়ের দোয়া ছাড়া এই দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব ছিল না। সবশেষে মিথিলা জানান, মিস ইউনিভার্সের অভিজ্ঞতা তাকে মানুষ হিসেবে আরও শক্তিশালী করেছে এবং ভবিষ্যতে তিনি নারীর ক্ষমতায়ন ও দেশের ভাবমূর্তি উন্নয়নে আরও জোরালো ভূমিকা রাখতে চান।
![]()
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিথিলা তার পোশাক ও উপস্থাপনা নিয়েও কথা বলেছেন। জাতীয় পোশাক পর্বে লাল-সবুজের অনুপ্রেরণায় তৈরি শাড়ি নিয়ে তিনি জানিয়েছেন, এই পোশাকের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাপূর্ণ ও শৈল্পিক পরিচয়ে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে সেই প্রচেষ্টা স্বীকৃতি পাওয়ায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। একইভাবে প্রশ্নোত্তর পর্বে নারী শিক্ষা ও আত্মনির্ভরতা নিয়ে তার বক্তব্যকে তিনি নিজের বিশ্বাসের প্রতিফলন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
তবে দেশে ফিরে পরিস্থিতি যে সহজ ছিল না, সেটিও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে। একাধিক পত্রিকায় তিনি বলেছেন, দেশে ফেরার পর বুঝেছেন তার অংশগ্রহণকে ঘিরে সমাজে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। কেউ তাকে সাহসী ও অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে দেখেছেন, আবার কেউ কঠোর সমালোচনাও করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন, এই সমালোচনা তাকে আঘাত করেছে, তবে একই সঙ্গে তাকে বাস্তবতাও শিখিয়েছে।
![]()
মিস ইউনিভার্সের মঞ্চ থেকে দেশে ফিরে তানজিয়া জামান মিথিলার অভিজ্ঞতা এখন আর কেবল একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার গল্পে সীমাবদ্ধ নয়। এটি ধীরে ধীরে রূপ নিয়েছে আত্মপরিচয়, প্রতিনিধিত্ব, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং নারীর স্বাধীন সিদ্ধান্তের প্রশ্নকে ঘিরে একটি বিস্তৃত আলোচনায়। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে ফিরে এসে যখন তিনি তারকাকথণ অনুষ্ঠানে হাজির হন, তখন সেই উপস্থিতি ছিল শুধু ব্যক্তিগত সাফল্যের বর্ণনা নয়, বরং দেশজুড়ে চলমান বিতর্ক ও প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করার একটি সচেতন প্রয়াস।
এই সাফল্যের পেছনের যাত্রা যে সহজ ছিল না, সেটি মিথিলা নিজেই বারবার উল্লেখ করেছেন। ২০২০ সালে মিস ইউনিভার্স বাংলাদেশের মুকুট অর্জন করলেও কোভিড পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিক মঞ্চে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি তিনি। চার বছর পর নতুন উদ্যমে, দীর্ঘ প্রস্তুতি ও পেশাদার প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে আবারও একই স্বপ্ন নিয়ে ফিরে আসা ছিল তার জন্য মানসিকভাবে যেমন কঠিন, তেমনি দৃঢ়তারও পরীক্ষা। ঢাকায় জাতীয় পর্যায়ে মুকুট পরার পর থেকেই তিনি স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, এবার তিনি শুধু অংশগ্রহণকারী নন, বরং প্রতিযোগী হিসেবেই মঞ্চে দাঁড়াতে চান।
মিস ইউনিভার্সের প্রাথমিক রাউন্ডগুলোতেই মিথিলা তার উপস্থিতি দিয়ে আলাদা নজর কাড়েন। সাঁতারের পোশাক পর্বে তার আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গি এবং পরিমিত ক্যাটওয়াক আন্তর্জাতিক অনলাইন কমিউনিটিতে প্রশংসিত হয়। জাতীয় পোশাক পর্বে লাল-সবুজের অনুপ্রেরণায় তৈরি শাড়ি, যেখানে বাংলাদেশের পতাকা, পদ্মফুল, জামদানি ও দেশীয় কারুশিল্পের ছাপ স্পষ্ট ছিল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। Missosology এবং Global Beauties-এর মতো আন্তর্জাতিক সৌন্দর্য বিশ্লেষণ প্ল্যাটফর্ম এই পোশাককে বছরের অন্যতম নান্দনিক জাতীয় পোশাক হিসেবে উল্লেখ করে, যা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে বিশ্বদরবারে নতুনভাবে তুলে ধরে।
তবে মিথিলার শক্তি শুধু রূপ বা পোশাকে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রশ্নোত্তর পর্বে নারী শিক্ষা ও আত্মনির্ভরতার গুরুত্ব নিয়ে তার বক্তব্য আন্তর্জাতিক বিচারক ও দর্শকদের দৃষ্টি কাড়ে। তিনি যখন বলেন, বাংলাদেশের মেয়েরা আজ শুধু ঘরের চার দেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিভিন্ন পেশায় নেতৃত্ব দিচ্ছে, তখন সেই বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশে ব্যাপক আলোচনা তৈরি করে। এই বক্তব্যে অনেকেই মিথিলাকে কেবল সৌন্দর্য প্রতিযোগী নয়, বরং একটি সামাজিক পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে দেখতে শুরু করেন।
এই আন্তর্জাতিক যাত্রার পর দেশে ফিরে তারকাকথণ অনুষ্ঠানে মিথিলার উপস্থিতি নতুন মাত্রা যোগ করে আলোচনায়। সেখানে তিনি শুরুতেই স্বীকার করেন, মিস ইউনিভার্সের মঞ্চে দাঁড়ানো তার জীবনের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা। এটি যে শুধু র্যাম্পে হাঁটা বা ক্যামেরার সামনে দাঁড়ানো নয়, বরং নিজের দেশ, সংস্কৃতি ও ব্যক্তিত্বকে একসঙ্গে বহন করার দায়িত্ব—এই উপলব্ধি তাকে ভেতর থেকে বদলে দিয়েছে বলে তিনি জানান। বিভিন্ন দেশের প্রতিযোগীদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে তিনি বুঝেছেন, প্রত্যেকেই নিজ নিজ সমাজের বাস্তবতা ও সংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করেই সেখানে দাঁড়ায়।
তারকাকথণে মিথিলা খোলাখুলিভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিতর্কের কথাও বলেন। তিনি স্বীকার করেন, দেশে ফিরে বুঝেছেন, তার অংশগ্রহণকে অনেকেই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হিসেবে দেখেননি; বরং সেটিকে ঘিরে সমাজে নানা ধরনের ব্যাখ্যা, প্রশ্ন এবং কখনো কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণও হয়েছে। তার ভাষায়, এই সমালোচনা একদিকে তাকে কষ্ট দিয়েছে, অন্যদিকে তাকে মানসিকভাবে শক্ত করেছে। কারণ, প্রকাশ্য মঞ্চে দাঁড়ালে সমালোচনাও দায়িত্বের অংশ—এই সত্য তিনি নতুন করে উপলব্ধি করেছেন।
তারকাকথণে উঠে আসে তার মানসিক চাপের কথাও। প্রতিযোগিতার সময় যে চাপ ছিল, দেশে ফিরে সেটি ভিন্ন রূপ নেয়। কখনো কখনো মনে হয়েছে, তিনি শুধু একজন প্রতিযোগী নন, বরং একটি প্রতীকে পরিণত হয়েছেন—যাকে ঘিরে সমাজের নানা প্রত্যাশা, ক্ষোভ ও আবেগ জমা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পরিবার ও কাছের মানুষদের সমর্থন তাকে স্থির থাকতে সাহায্য করেছে বলে তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করেন।
মিথিলা বারবার জোর দেন আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে। তার মতে, মিস ইউনিভার্সে অংশ নেওয়ার আগে এবং পরে তিনি একই মানুষ। আন্তর্জাতিক মঞ্চ তাকে নতুন অভিজ্ঞতা দিয়েছে, কিন্তু তার মূল্যবোধ বদলায়নি। তিনি বিশ্বাস করেন, একজন নারী নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে—এটাই স্বাভাবিক। সমাজ সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হোক বা না হোক, আলোচনাটা হওয়া উচিত সম্মান ও যুক্তির জায়গা থেকে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই অভিজ্ঞতা তার জীবনের শেষ অধ্যায় নয়, বরং নতুনভাবে শুরু করার একটি ধাপ। তিনি চান, তরুণীরা যেন নিজেদের সীমাবদ্ধ ভাবা বন্ধ করে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাওয়ার সাহস পায়। তার মতে, মিস ইউনিভার্স তাকে শিখিয়েছে কীভাবে ভয়কে পাশ কাটিয়ে সামনে এগোতে হয়।
এই পুরো যাত্রাকে তিনি দেখছেন শেখার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে। সাফল্য বা ব্যর্থতার হিসাবের চেয়ে তার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, এই অভিজ্ঞতা তাকে কী শিখিয়েছে। আত্মবিশ্বাস, সহনশীলতা এবং নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে বলার সাহস—এই তিনটি বিষয়ই তিনি মিস ইউনিভার্স থেকে সঙ্গে করে এনেছেন বলে জানান।
সব মিলিয়ে তানজিয়া জামান মিথিলার মিস ইউনিভার্স যাত্রা ও দেশে ফিরে তার বক্তব্য আজ শুধু একটি সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার গল্প নয়। এটি সমসাময়িক বাংলাদেশে নারী, পরিচয়, প্রতিনিধিত্ব এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলমান বৃহত্তর আলোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে উঠেছে। একটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে একজন বাংলাদেশি নারীর আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর কীভাবে দেশের কথা বলে। কিভাবে নতুন ভাবনার জন্ম দেয়, মিথিলার অভিজ্ঞতা তারই এক স্পষ্ট উদাহরণ।