
বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর আজ এক সংকটময় পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে আশঙ্কাজনক ৪৫.৭৯ শতাংশে। এ অবস্থায় প্রাইভেট সেক্টরেও অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে, যা সেক্টরের সামগ্রিক স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্বল কর্পোরেট গভর্নেন্স, পর্যাপ্ত ক্যাপিটাল না থাকা এবং প্রযুক্তির পিছিয়ে পড়া, এ সব কিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমে এসেছে। অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং অনিশ্চয়তার এই পরিবেশে যে কোনও প্রতিষ্ঠানের জন্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয়ে পড়েছে কঠিন।
দেশের বিদ্যমান এসব চ্যালেঞ্জের মাঝে এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন কাইজার চৌধুরী, যিনি চার দশকেরও বেশি সময় ধরে ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ করে নিজেকে একটি পারদর্শী ও দূরদর্শী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার নেতৃত্বে এবি ব্যাংক শুধু নিজেদের আর্থিক অবস্থান মজবুত করবে না, পাশাপাশি দেশের ব্যাংকিং ইকোসিস্টেমের জন্য নতুন প্রত্যয় এবং আস্থার আলোও জ্বালাতে সক্ষম হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্যাংকিং ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই তার ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, কর্পোরেট গভর্নেন্স এবং আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংকিং প্রযুক্তি সংযোজনের ওপর গুরুত্ব আরোপ তাকে এই সেক্টরের অন্যতম সফল নেতা হিসেবে ধরা হয়।
১৯৭৫ সালে গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকে যোগ দিয়ে কাইজার চৌধুরীর ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু হয়। দীর্ঘ ২৪ বছরের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি ঝুঁকি বিশ্লেষণ, কর্পোরেট গভর্নেন্স, এবং আর্থিক সেবায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেন। এরপর ১৯৯৯ সালে ওয়ান ব্যাংকে ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিয়ে কর্পোরেট ও রিটেইল ব্যাংকিংয়ে নিজের অভিজ্ঞতার ছাপ রাখেন। ২০০৫ সালে এবি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও পরে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে ব্যাংকটির আধুনিকায়ন এবং প্রবৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন। তার নেতৃত্বে কর্পোরেট লোন পোর্টফোলিও বিস্তৃত হয়েছে, আন্তর্জাতিক লেনদেনের পরিধি বেড়েছে, এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তার স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বিশ্বাস করেন, টেকসই ব্যাংকিংয়ের জন্য ক্যাপিটাল প্রিজার্ভেশন, অ্যাসেট কোয়ালিটি, এবং গ্রাহকের আস্থার ভারসাম্য বজায় রাখা অপরিহার্য। বর্তমান এনপিএর উদ্বেগজনক মাত্রা বিবেচনায়, তার কঠোর ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া, সেক্টরভিত্তিক ঝুঁকি বিশ্লেষণ এবং প্রোঅ্যাকটিভ রিকভারি কৌশল ব্যাংকিং খাতের জন্য নতুন দিশানির্দেশ হতে পারে। তিনি মনে করেন, ঝুঁকি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করলে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকিং সেক্টরের টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব।
এসএমই সেক্টরকে কাইজার চৌধুরী দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হিসেবে দেখেন। এসএমই সেক্টর শুধু কর্মসংস্থান তৈরি করে না, এটি দেশের অভ্যন্তরে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস এবং রপ্তানি পোর্টফোলিও বৈচিত্র্যকরণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে এই সেক্টরের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে দরকার সাশ্রয়ী সুদহার, দ্রুত ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ। কাইজার চৌধুরী ডিজিটাল ফিনটেক-এনাবলড ল্যান্ডিং এবং আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। তার লক্ষ্য এসএমই সেক্টরকে শক্তিশালী করে দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করা।
বর্তমান ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল কর্পোরেট গভর্নেন্সে সিস্টেম্যাটিক দুর্বলতা। রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়ম এবং দুর্নীতি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাংকের সুনাম ক্ষুণ্ণ করেছে। প্রথম প্রজন্মের এবি ব্যাংক এক সময় সেবায় কর্পোরেট স্ট্যাটেজির মাধ্যমে গ্রাহক আকর্ষণে শীর্ষে অবস্থান করেছিল। যার পেছনে ছিল নিষ্ঠাবান ও দক্ষ কর্মকর্তাদের অবদান। যার ফলে ব্যাংকটির বিভিন্ন আর্থিক সূচক যথেষ্ট উন্নতি লাভ করে। তবে পরবর্তী সময়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনিয়ম ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ায়, পাশাপাশি কিছু উদ্যোক্তার অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের কারণে ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়। খেলাপি ঋণের পরিমাণ এমনভাবে বৃদ্ধি পায় যে, নিরাপত্তামূলক সঞ্চিতি যথাযথ পরিমাণে রাখলে ব্যাংকটির লোকসান আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পেত। তবে কাইজার চৌধুরী ব্যাংটির দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বদলাতে শুরু করেছে ব্যাংকের সার্বিক পরিস্থিতি। অর্থনৈতিক ভাবে ঘুরে দাড়িয়ে নতুন করে পথ চলার পরিকল্পনা আসছে তাঁরই নেতৃত্বে।
কাইজার চৌধুরী দৃঢ় বিশ্বাস করেন, বোর্ডের স্বাধীনতা (বোর্ড ইন্ডিপেনডেন্স), স্বচ্ছতা (ট্রান্সপারেন্সি) এবং জবাবদিহিতা (অ্যাকাউন্টেবিলিটি) ছাড়া ব্যাংকের টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তার নেতৃত্বে এবি ব্যাংকের বোর্ড এই নীতিমালা পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে। ব্যাংকের প্রতিটি সিদ্ধান্তে শেয়ারহোল্ডার এবং গ্রাহকের স্বার্থ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে, যা আধুনিক স্টেকহোল্ডার সেন্ট্রিক গভর্নেন্সের বাস্তব রূপ।
ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশনে দিকে বর্তমানে এবি ব্যাংক বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কাইজার চৌধুরী বলেন, রিয়েল-টাইম অনলাইন ব্যাংকিং, সাইবার সিকিউরিটি এবং অটোমেটেড কাস্টমার সার্ভিস ছাড়া আধুনিক ব্যাংকিং কল্পনা করা যায় না। তরুণ গ্রাহক যারা মোবাইল-ফার্স্ট এবং ডিজিটাল-নেটিভ, তাদের জন্য নিরাপদ ও মসৃণ ডিজিটাল অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবী। এছাড়াও ডাটা অ্যানালিটিক্স এবং এআই-ড্রিভেন গ্রাহক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কাস্টমার সার্ভিস উন্নয়নও তার অগ্রাধিকার। এসব উদ্যোগ সঠিক ভাবে প্রণয়ন হলে ব্যাংকের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াবে এবং ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল ইকোসিস্টেমে টেকসই প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা তৈরি করবে বলেও মনে করা হচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্ব তথা বাংলাদেশের অর্থনীতির সামগ্রিক চ্যালেঞ্জও ব্যাংকিং খাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, মুদ্রাস্ফীতি, আমদানি ব্যয়ের ভারসাম্যহীনতা এবং রপ্তানি আয়ের কমতি ব্যাংকগুলোর লিকুইডিটি ও পরিচালনাকে কঠিন করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে এলসি খোলার ঝামেলা বেড়েছে, যা আমদানিনির্ভর শিল্প ও সরবরাহ শৃঙ্খলায় বাধা সৃষ্টি করছে। এ বিষয়ে ব্যাংকার কাইজার চৌধুরী মনে করেন এসব বিষয় ফেস করতে ব্যাংকগুলোর দক্ষতা বাড়িয়ে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থাপনা ও রিজার্ভ চাপ কমানো প্রয়োজন এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি জরুরি।
ব্যাংকিংয়ের কঠিন জগতের বাইরেও কাইজার চৌধুরী বাংলাদেশের একজন প্রধান এবং পরিচিত শিশুসাহিত্যিক হিসেবেও সুপরিচিত। ৫০টিরও বেশি শিশুতোষ বইয়ের রচয়িতা তিনি। ব্যাংকিং এবং সাহিত্য দুটি পৃথক ক্ষেত্র হলেও তার মতে দুটির মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, “ব্যাংকিং শুধু সংখ্যার খেলা নয়, এটি মানুষের স্বপ্ন এবং সম্ভাবনার সঙ্গে জড়িত।” সাহিত্যের মাধ্যমে বিকশিত অনুভূতি এবং স্বত্ত্বা তার কর্পোরেট নেতৃত্বে মানবিকতা যোগ করে, যা কঠোর আর্থিক জগতকে নিয়ে আসে সৃজনশীলতার মলাটে।
এবি ব্যাংকের পুনরুত্থান শুধুমাত্র আর্থিক সূচকের উন্নতি নয়, বরং ব্যাংকের সংস্কৃতি এবং গ্রাহক আস্থা পুনঃস্থাপনের সংগ্রাম। কাইজার চৌধুরীর বর্তমান রোডম্যাপে গুরুত্ব পাচ্ছে কর্পোরেট গভর্নেন্স পুনঃপ্রতিষ্ঠা, খেলাপি ঋণ হ্রাস, প্রযুক্তিনির্ভর গ্রাহক সেবা সম্প্রসারণ, এসএমই ঋণের বিস্তার এবং কর্মী প্রশিক্ষণ ও নৈতিকতা জোরদার করার মতো বিষয়। তবে তিনি মনে করেন, এ সব ক্ষেত্রে সফলতার জন্য দরকার রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থার সমর্থন এবং অভ্যন্তরীণ সুশাসনের ধারাবাহিকতা।
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তা সহজ নয়। তবে ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে দক্ষ নেতৃত্ব ও দূরদর্শিতা থাকলে সংকট নতুন সুযোগে রূপান্তরিত হয়। কাইজার চৌধুরীর অভিজ্ঞতা, স্ট্র্যাটেজিক ভিশন এবং আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা এবি ব্যাংককে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে এবং দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য নতুন দিগন্তের সূচনা করতে পারে। এখন দেখার বিষয় কত দ্রুত এবং কত দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবেন এবং ব্যাংকিং খাতের আস্থা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন।
এভাবেই কাইজারের নেতৃত্বে এবি ব্যাংক বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের একটি নতুন অধ্যায় শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সংকট থেকে উত্তরণের পথ সুগম করে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করাই তার মূল লক্ষ্য। এর প্রভাব শুধু ব্যাংকটিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং পুরো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার সম্ভাবনা বহুগুণ। দেশের ব্যাংকিং খাতে অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, যোগ্যতা এবং মেধার মাণদণ্ডে অন্যতম প্রধান অবস্থানে থাকা কাইজার চৌধুরী দূরদর্শিতা, আধুনিক ভাবনা এবং মানবিক স্পর্শ এবি ব্যাংককে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করছেন, যা বাংলাদেশের আর্থিক খাতকে আরও শক্তিশালী করে জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।