রাজু আলীম: ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসেই বিদেশে সরকারি খরচের লাগাম টেনেছেন। সেই পটভূমিতে যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রোহিঙ্গা সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশের বাকি সব কার্যক্রম আপাতত তিন মাসের জন্য গুটিয়ে নিয়েছে। এরমধ্যেই এই আদেশের প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে ইউএসএআইডির অর্থায়নে চলমান প্রকল্পের কাজ বন্ধ বা স্থগিত করা হয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতন্ত্র ও শাসন ব্যবস্থা, পরিবেশ, জ্বালানি এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমও গতি হারিয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান দিয়েছে কর্মী ছাঁটাইয়ের নোটিশ।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সিদ্ধান্তকে দেশের জন্য যেমন উদ্বেগের, তেমনই কারিগরি সহায়তা খাতে এর দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব পড়বে। এজন্য এখন থেকেই কূটনৈতিক উদ্যোগের পাশাপাশি চালিয়ে যেতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা। তাদের এটি বোঝাতে হবে, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সহযোগী দেশ।
মার্কিন তহবিল পাওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের অংশীদার বাংলাদেশ। ৫০ বছরেরও বেশি সময় জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, জ্বালানি, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ খাতে অর্থ সহায়তা দিচ্ছে ইউএসএআইডি। তাদের অনুদান পাওয়া অনেক এনজিও এবং সরকারি সংস্থা রয়েছে। সংস্থাটি গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশকে প্রায় ২০ কোটি ২২ লাখ ডলার অর্থ সহায়তা দেওয়ার চুক্তি করে। এর আগে ২০২১ সালে, ২০২৬ সালের জন্য ৯৫ কোটি ৪০ লাখ ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় ইউএসএআইডি। পঞ্চম সংশোধনী পর্যন্ত ইউএসএআইডি সাড়ে ৪২ কোটি ডলার দিয়েছে। ১৯৭৪ সালে সই হওয়া ‘অর্থনৈতিক প্রযুক্তিগত ও সম্পর্কিত সহায়তা’চুক্তির অধীনে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন খাতে ৮০০ কোটি ডলারের বেশি তহবিল দিয়েছে।
‘ফরেন অ্যাসিস্ট্যান্স ডট গভ’ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে ২০২১ সালে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ৪৭০ মিলিয়ন ডলার, ২০২৩ সালের ৪৯০ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২৪ সালে ৪৫০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর ওয়াশিংটন বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। গেল কয়েক বছরে মার্কিন সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষ দশে ছিল বাংলাদেশ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্র এইচআইভি, ম্যালেরিয়া ও যক্ষ্মা রোগের জীবন রক্ষাকারী ওষুধের সরবরাহ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। এতে চলমান অনেক প্রকল্পের কাজই শুধুই বন্ধ হয়নি, পাশাপাশি অর্থের অভাবে দেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন কর্মসূচি অপারেশনাল প্ল্যানের (ওপি) কর্মকাণ্ড গত সাত মাস বন্ধ আছে। এতে বন্ধ আছে ২০ হাজারেরও বেশি কর্মীর বেতন। এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা স্থগিতে স্বাস্থ্য খাতে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এতে এইচআইভি-এইডস, যক্ষ্মা, ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, ম্যালেরিয়া অপুষ্টিজনিত নানা সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
গণমাধ্যমের তথ্যমতে, ইউএসএআইডি বাংলাদেশ সরকারকে সরাসরি অর্থায়ন কম করে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে স্বাস্থ্যের নানা রোগ প্রতিরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাটি। করোনাকালে কম দামে টিকা দেওয়াসহ ৬৪ জেলায় ৫০ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীর প্রশিক্ষণ দেয় সংস্থাটি। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ৮ কোটি ৪০ লাখ টিকা সহায়তা দিয়েছিল। এ ছাড়া করোনা-পরবর্তী মানসিক উন্নয়ন ও মানবিক সহায়তায় ১৪ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। শুধু টিকা নয়, নানা সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে দেশে ইউএসএআইডি সহায়তায় এখনও অনেক প্রকল্প চলমান, যা ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক আদেশে স্থবির হয়ে গেছে।
সহায়তা বন্ধের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আইসিডিডিআর,বি হাজারের বেশি কর্মী ছাঁটাই করেছে। এতে স্বাস্থ্য খাতে বড় বড় গবেষণা বন্ধ হয়ে যাবে। সেবায় বড় প্রভাব পড়বে। তাদের তহবিলে পরিচালিত হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এতে বঞ্চিত হবেন লাখ লাখ রোগী। বিশেষ করে টিকা পেতে জটিলতা দেখা দেবে। নগর স্বাস্থ্য উন্নয়নে তিন মাস আগের প্রকল্প ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে পুষ্টি-সংক্রান্ত দুটি প্রকল্পও। যক্ষ্মার দুটি প্রকল্প আছে, সেগুলো চালু থাকবে কিনা, এখনও পরিষ্কার নয়। এসব প্রকল্প বন্ধ হলে একদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চাকরি হারাবেন, অন্যদিকে এসব প্রকল্পের সুবিধাভোগী মানুষও উপকার পাবেন না।
স্বাধীনতার পর থেকেই প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো। দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পে প্রতিনিয়ত বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন। বাংলাদেশে সুশাসন ও জবাবদিহি বাড়াতেও ইউএসএআইডির বিভিন্ন প্রকল্প চলমান ছিল। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে ইউএসএআইডির কর্মসূচি পরিচালিত হতো। এসব প্রকল্প এখন বন্ধ হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা এই পরিস্থিতিকে চাপ সৃষ্টিরও কৌশল হিসেবে দেখছেন। এদিকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা নির্ভর করে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। বাস্তবতা বলছে, এর বিপরীতে রাতারাতি কোন পরিবর্তন আসবেনা। এর বাইরে সংস্কার, দুর্নীতি প্রতিরোধ, অর্থনৈতিক পুনর্গঠনসহ অধিকাংশ ইস্যুই নানা সীমাবদ্ধতায় দুষ্ট। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সুষ্ঠ নির্বাচনের আয়োজন।
একদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় সংকোচনের বেড়াজাল আর অন্যদিকে সাম্য ও মানবিক মর্যাদার প্রশ্নে কোন মানুষের দীর্ঘ প্রতীক্ষা। অনিশ্চয়তার অন্ধকার ঠিক কতটা গ্রাস করেছে, সময় নিশ্চয় তার প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তুলবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনার পতনের যুদ্ধে সার্বিক অংশগ্রহণ যেমন ছিলো, তেমনই একক দল হিসেবে বিএনপির ছিলো কার্যকর অংশগ্রহণ ও মূল্য প্রদান। জুলাই গণহত্যায় ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে শহীদের কমপক্ষে ৪২২ জন বিএনপি’র রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার জানানো হয়েছে দলটির পক্ষ থেকে।
ক্ষমতায় গেলে দেশের মানুষের প্রত্যাশার প্রতিফলন যেন দেয়া যায়, সেই লক্ষ্যে নিয়মিত দেশবাসী ও নেতাকর্মীদের গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে পানির ন্যায্য হিস্যার জন্য জাতিসংঘে যাবে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে অসম, অন্যায্য ও একতরফা সব চুক্তি পুনর্বিবেচনা করা হবে। দুরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপে নয়া আশার সঞ্চার করেছেন তিনি। সীমান্ত হত্যা বন্ধসহ কূটনৈতিক স্থবিরতা নিরসনে কার্যকর পুরিকল্পনা ও পদক্ষেপের বার্তায় আশাবাদ তৈরি হয়েছে জাতীয় পরিসরে।
তবে মার্কিন ক্ষমতার পালাবদলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনে যে প্রভাবের আলাপ ডালপালা মেলছে, তার অনেকটাই ভিত্তিহীন বলে মত বিশ্লেষকদের। বাইডেন প্রশাসনের বাংলাদেশের জন্য যে ফরেইন পলিসি ছিলো, ট্রাম্প প্রশাসনের সেই একই ফরেইন পলিসি থাকবে বলেই মত অনেকের। এমনটা ট্রাম্পের প্রথম টার্মেও হয়েছে। তবে চীন যদি ইস্যু হয় সেই কারণে হলে বাংলাদেশ ট্রাম্পের কাছে গুরুত্ব পেতে পারে। আবার ভারত যদি বাংলাদেশের ব্যাপারে চাপ দেয় সেটারও একটা চাপ বাংলাদেশের ওপর পড়তে পারে। তবে কোনো কিছুই এখনো স্পষ্ট নয়।