মিল্টন সমাদ্দার। অনেকের কাছে তার পরিচয় সমাজ সেবক হিসেবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত বাংলাদেশের এই ব্যক্তি। কিন্তু সম্প্রতি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয় যে, মানবিক কাজের আড়ালে তিনি নানা অপকর্ম চালিয়ে যেতেন।
তার বিরুদ্ধে ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতি, মানবপাচার, আশ্রয় দেওয়া অসহায় ও দুস্থ ব্যক্তিদের কিডনিসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি, জমি দখল, অসহায় মানুষের নামে সংগ্রহ করা অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অভিযোগ ওঠেছে। আর এসব অভিযোগের জেরে তিনি এখন কারাগারে। এমনকি তাকে তিনদিনের রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। তবে কয়েকটি গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিয়ে তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন মিল্টন সমাদ্দার।
কে এই মিল্টন সমাদ্দার
মিল্টন সমাদ্দারের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে। ফেসবুকে মিল্টন সমাদ্দার নিজের পরিচয় সম্পর্কে তিনটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
প্রতিষ্ঠানগুলো হলো- চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার, চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার ফাউন্ডেশন ও মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেড। এরমধ্যে প্রথম দুটিকে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মিল্টন হোম কেয়ার প্রাইভেট লিমিটেডকে কোম্পানি হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।
মিল্টন সমাদ্দার নিজের ফেসবুক পেজে যেসব ভিডিও প্রকাশ করেছেন সেখানে বিভিন্ন সময়ে তিনি তার প্রতিষ্ঠানকে আশ্রম বলে তুলে ধরেছেন।
ডিবি পুলিশ বলছে, নিজের বাবাকে পিটিয়ে এলাকা ছাড়া হন মিল্টন। এরপর ঢাকায় এসে শাহবাগে এসে একটি ফার্মেসিতে কাজ করেন। সেখানে ওষুধ চুরির কারণে তাকে বের করে দেওয়া হয়। পরে মিঠু হালদার নামের এক নার্সকে বিয়ে করেন। বিয়ে করার পর স্ত্রীকে নিয়ে মিরপুরে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ার’ নামের আশ্রয়কেন্দ্র খুলে বসেন। তিনি বেশি দূর লেখাপড়া করেননি।
মিল্টন নিজের ফেসবুকে দাবি করছেন, রাস্তায় পড়ে থাকা অসহায় ও আশ্রয়হীন বৃদ্ধ এবং শিশুদের খুঁজে বেড়ানো তার নেশা। মানুষের দান আর নিজের ব্যবসা থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে কুড়িয়ে পাওয়া বৃদ্ধ ও শিশুদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করেন তিনি। এজন্য তিনি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেয়েছেন।
যেভাবে আলোচনায় মিল্টন
ফেসবুকে এক কোটি ৬০ লাখ মানুষ তাকে অনুসরণ করে। শুরু থেকেই মিল্টন তার কর্মকাণ্ডের ভিডিও নিজের ফেসবুক পেজে শেয়ার করেন। এসব ভিডিতে সড়কে পড়ে থাকা অসহায় বৃদ্ধ, মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তি, আশ্রয়কেন্দ্রের শিশুদের অনেক কিছু থাকে।
ফেসবুকে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিওতে এসব অসহায় মানুষদের সাহায্য করার জন্য বিভিন্ন সময়ে সমাজের বিত্তবানদের কাছে সাহায্যও চেয়েছেন তিনি। তার আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের বাবা-মা ও শিশুদের সন্তান বলে সম্বোধন করেন মিল্টন।
মিল্টন সমাদ্দার দাবি করেন, তার আশ্রমে সব সময় ২৫০-৩০০ অসুস্থ রোগী থাকেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে রাস্তায় যারা মারা যান, তাদের নিয়ে দাফন করেন। আবার তার আশ্রমে অবস্থানকালেও অনেকে মারা যান।
মরদেহে কাটাছেঁড়া, ডাক্তার না হয়ে মৃত্যু সনদ নিজেই দেন
মিল্টন সমাদ্দারের দক্ষিণ পাইকপাড়া আশ্রমের কাছেই বায়তুর সালাম জামে মসজিদে এক সময় তার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসা মরদেহ বিনামূল্যে গোসল করানো হতো। তার মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে মসজিদ কর্তৃপক্ষ তাকে এই সুবিধা দিয়েছিল। তবে গোসল করানোর সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা প্রায় প্রতিটি মরদেহের বিভিন্ন স্থানে কাটাছেঁড়ার দাগ শনাক্ত করেন। করোনার সময় এ বিষয়ে মিল্টনকে প্রশ্ন করে মসজিদ কর্তৃপক্ষ। এরপর তিনি ওই মসজিদে মরদেহ পাঠানো বন্ধ করে দেন।
স্থানীয় একটি মাদ্রাসার পরিচালক তোফাজ্জল হোসেন বলেন, মিল্টন এক সময় বাসা ভাড়া পরিশোধ করতে পারতেন না। এখন তিনি এগুলো করে কোটি কোটি টাকার মালিক। দামি গাড়িতে চড়েন। আমরা শুনেছি আড়ালে তিনি মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চুরি করেন।
বরিশালে চার্চ দখলের অভিযোগ
বরিশালে ‘চন্দ্রকোনা খ্রিষ্টান মিশনারি চার্চ’ দখল চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে। দখলের উদ্দেশ্যে তিনি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিল-স্বাক্ষর জাল করে চার্চের নতুন কমিটি গঠন করে বরিশাল জেলা প্রশাসকে একটি চিঠি দেন। ওই কমিটিতে সভাপতি করা হয় মিল্টন সমাদ্দারকে। কমিটির বাকি সদস্যদের প্রায় সবাই মিল্টনের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন। তবে এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না চার্চের দায়িত্বরত যাজকরা। জালিয়াতি করে চার্চ দখল করতে চাওয়া ব্যক্তিদের ওই চার্চের সীমানায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত
সুনসান মিল্টনের সেই আশ্রম
এদিকে ৩ মে ঢাকার মিরপুরের দারুস সালাম এলাকার কল্যাণপুর নতুন বাজার রোডে অবস্থিত চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারে প্রবেশ করে দেখা যায়, পুরো প্রতিষ্ঠানটি সুনসান ও নীরব। প্রধান ফটকটি বন্ধ। প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট ছাড়া বহিরাগত কেউই সেখানে প্রবেশ করতে পারছেন না।
কথা হয় এখানের নিরাপত্তাকর্মী রাসেলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ডিবি পুলিশ এখানে সবার জন্য প্রবেশ নিষেধ করে দিয়েছে। হয় ডিবি থেকে অনুমতি আনতে হবে, অথবা প্রশাসনসহ এখানে প্রবেশ করতে হবে। যতদিন অবধি সমস্যার সমাধান না হবে ততদিন অবধি এই নিয়মে চলবে।
মিল্টনের বক্তব্য
নিজের বাবা-মাকে মারধরের অভিযোগ খণ্ডন করেন মিল্টন। সুষ্ঠু তদন্ত শেষে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে দেশের আইন ও প্রশাসন যে শাস্তি দেবে তা মাথা পেতে নেওয়ার কথা বলে গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন তিনি।
এদিকে ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন মিল্টন সমাদ্দার। তবে আশ্রয়কেন্দ্রের আগের কর্মচারীরা চিকিৎসক সেজে তার অজ্ঞাতসারে স্বাক্ষর জাল করেছেন বলে দাবি সমাদ্দারের।
মিল্টনের আইনজীবী মো. ওহিদুজ্জামান বিপ্লব ফেসবুক ভিডিওতে দাবি করেছেন, “সাভারে আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য যে স্থায়ী ভবন বানানো হয়েছে সেখানে জমি ও রাস্তা সংক্রান্ত জটিলতায় মিল্টনের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলা হয়েছে।”
মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় তিনটি মামলা হয়। এসব মামলায় ডেথ সার্টিফিকেট জালিয়াতি, মানব পাচার, হত্যার উদ্দেশ্যে মানুষকে নির্যাতনের অভিযোগ আনা হয়েছে।