নিষিদ্ধ শব্দটার ভেতর একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। নিষিদ্ধ হলে বই এর কাটতি বাড়ে. যে সিনেমাকে নিষিদ্ধ করা হয় সেটি দেখার জন্য নাকি মানুষ মুখিয়ে থাকে। জহির রায়হানের পরিচালনায় ‘জীবন থেকে নেয়া’ নিষিদ্ধ করা হলে সেটা দেখার জন্য মানুষ রাস্তায় নেমেছিল। কিছুদিন পর পর ছাত্র রাজনীতি নিয়েও এই সিদ্ধ নিষিদ্ধের ব্যাপারটা চলে আসে।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছাত্র সন্ত্রাসের কারণে একটা সির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলে সমালোচিত হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে স্বাধীনতার আগে ঢাকা কলেজ বা তিতুমীর কলেজের মতো কলেজগুলোতে ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে নির্বাচন করা যেত না। ফুল,পাখি বা নদীর ব্যানারে তখন প্যানেল ঘোষণা হতো এবং ছাত্ররা বুঝতো কোনটা কোন দলের সংগঠন বা লেজ। স্বাধীনতার পর এই পরিস্থিতি বদলে যায়।
এরশাদ আমলে এটা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ঘোলা হয়েছে জল। এরশাদ প্রথম ক্ষমতায় এসে ‘স্টুডেন্ট ব্রিগেড’ করেছিলেন, ছাত্রদের শীতের কম্বল, টাকা, পয়সা, অস্ত্র সবই দেয়া শুরু করেছিলেন। লাভ হয় নি ‘জাতীয় ছাত্র সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেও। ছাত্ররাই তার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে এরশাদ সাহেব ‘জাতীয় ছাত্র সমাজ’ এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেন, বিরোধী ছাত্র সংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবও তুলেছিলেন। উদ্দেশ্যমূলক কোনো কিছু করলে শেষমেষ লাভ হয় না,নিজেদেরও বিদায় নিতে হয়। এরশাদের নিয়তিও তেমন ছিল।
কিন্তু এ কথা সত্য যে ১৯৮২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পরস্পর বিরোধী জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাথে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে যত জন নিহত হয়েছেন,ছাত্রদল বা ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে মারামারিতেও প্রায় সমান সংখ্যক ছাত্র নিহত হয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে ছাত্র শিবিরের সাথে ছাত্রদলের একবার মারামারি হলে সে সময়কার মন্ত্রী মতিন সাহেব বলেছিলেন-‘শিবিরের সাথে কেন মারামারি হবে? ওরা তো ভদ্র!’ আসলে রাজনীতির শিশু শ্রমিকদের (এই শব্দটা ব্যবহার করতেন শ্রদ্ধেয় আহমদ ছফা) কেউ কেউ ক্ষমতার ছায়া পেলে আর ভদ্র থাকে না। শিবিরের রেকর্ড আরো খারাপ।
ইসলামী ছাত্র সংঘ যেটা ১৯৭১ এ আলবদর,আল শামস বা রাজাকার বাহিনীতে সংযুক্ত হয়েছিল, এসর নেতাদের হাতেই স্বাধীন দেশে ১৯৭৭ এর পর শিবিরের গোড়াপত্তন।১৯৮০-৮১ সাল থেকে ৮৭ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক খুন ও রগকাটার সাথে এরা জড়িত। ছাত্র নেতা হামিদের হাতকেটে দেয়ার ছবি পত্রিকায় এসেছিল। এরপর শিবিরের হাতে সবচেয়ে বেশি খুন হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই পরিসংখ্যান তুলে থরলে একালের অনেক কথিত ভদ্র ছেলেদের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যাবে। খুলনা বিএল কলেজে বড় হত্যাকান্ড শুরুও শিবিরের হাতে। তারা ছাত্রদল নেতা আবুল কালাম আজাদকে নিমর্মম ভাবে খুন করেছিল। আবার শিবিরের অনেক নেতাও খুন হয়েছে প্রতিদ্বদ্বী সংগঠনের হাতে।
স্বাথীনতার পর সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকান্ড সেভেন মার্ডার যা মহসীন হলে হয়েছিল। মূলত ছাত্র সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিন কারণে মাঝে মাঝেই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের কথা ওঠে। ২০১৯ এ আবরার ফাহাদের নির্মম হত্যান্ডের পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। সবশেষে ২০২৫ এর আগস্টে এসে ঢাকা বিশ্বরিদ্যালয়ের হলে ছাত্র রাজনীতি না করার কথা বলা হয়। সেটা নিয়েও শুরু হয় নতুন বিতর্ক।
সম্ভবত কোনো ‘গুপ্ত ধারণা’র বাস্তব প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা করা হয়েছে। জুলাই জাগরণের আগে থেকেই এই ‘গুপ্ত ধারণা’ প্রচলিত ছিল। ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী ছিলেন সরাসরি শিবির থেকে আসা। জুলাই জাগরণের পর অনেকেই গুপ্ত পরিচয় থেকে বাস্তব পরিচয়ে এসেছেন।
গুপ্তধারনা থেকে করেছেন এ কারণে যে সামনে ডাকসু নির্বাচন হতে পারে। এখানে ইসলামী ছাত্রশিবির বা এমসিপি অথবা এদের মিলিত সংগঠনের জেতার কোনো সম্ভাবনা নেই। এদের ভেতর এখনো যারা গুপ্ত আছেন তারা এই ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণার ভেতর দিয়ে নিজেদেরকে আরেক দফা প্রকাশ করতে পারেন..
নিয়ত খারাপ হলে কোন গুপ্ত সিদ্ধান্ত কখনো বাস্তবায়িত হয় না। এরশাদ সাহেব যা পারেন নি, একালের এরশাদরাও তা পারবেন না…
জাতির প্রয়োজন এমন যে কোনো ক্রান্তিলগ্নে ছাত্ররা বারবার রাস্তায় নেমে আসতেন, গত জুলাইতে এসেছিলেন ভবিষ্যতেও আসবেন..
রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি বাদ দিয়ে শুদ্ধ রাজনীতি ও ক্যাম্পাস ভিত্তিক শিক্ষাচর্চা করলে ছাত্র সন্ত্রাস বন্ধ হতে পারে….
আহসান কবির