পাহাড়, নদী ও ঝর্ণার মিলনে অপরূপ সুন্দর বান্দরবান জেলা। শান্ত, মনোমুগ্ধকর এক গোছানো শহর। প্রকৃতির এই অসাধারণ সুন্দরের কাছে যেতে চায় সবাই। বিশেষ করে ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে এটি এক লোভনীয় স্থান। কিন্তু হঠাৎ শান্তির এই অঞ্চল হয়ে ওঠে অশান্ত। খুন, অপহরণ, সন্ত্রাস, ব্যাংক লুট, গোলাগুলিসহ এমন কোনো ঘটনা নেই যা এখানে ঘটেনি। আর এসব অস্থিরতার পেছনে সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে (কেএনএফ) দায়ী করা হচ্ছে। বান্দরবানে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী এ সংগঠনটি শুরু থেকেই এ অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসিত পৃথক রাজ্য প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে আসছে।
সবশেষ ২ এপ্রিল বান্দরবানের রুমা উপজেলা সদরে সোনালী ব্যাংকে হামলার ঘটনা ঘটে। ব্যাংক ঘেরাও করে হামলা চালায় কেএনএফ অস্ত্রধারীরা। ব্যাংকের ভল্টে থাকা এক কোটি ৫৯ লাখ টাকা নিতে পারেনি তারা। তবে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের ১৪টি অস্ত্র ও ৪১৫টি গুলি লুট করে। ওই ব্যাংকের ম্যানেজার মো. নেজাম উদ্দিনকে অপহরণ করা হয়। যদিও দুদিন পর বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রুমা থেকে তাকে উদ্ধার করে র্যাব।

এর পরদিন ৩ এপ্রিল দুপুরে থানচিতে সোনালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের শাখায় হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। এই দুই ব্যাংক থেকে সাড়ে ১৭ লাখ টাকা লুট করে অস্ত্রধারীরা। এরপর থেকেই বান্দরবানজুড়ে থমথমে অবস্থা শুরু হয়। আতঙ্কে বাসাবাড়ি ছাড়তে থাকেন স্থানীয়রা।
বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে থানচি বাজারে হামলা
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, কেএনএফ সদস্যরা হামলার আগে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বন্ধ করে দেয়। এতে থানচি উপজেলা পরিষদ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। অস্ত্রধারীরা বান্দরবান-রুমা সড়কের উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ের সামনের অংশে দুই পাশে ব্যারিকেড দেয়।
থানচি বাজার কমিটির সভাপতি ও থানচি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান খামলাই ম্রো বলেন, ‘কেএনএফ সন্ত্রাসীরা বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে থানচি বাজারের চারপাশে গুলিবর্ষণ করে। এক পর্যায়ে গুলি করতে করতে তারা থানচি থানার দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। এসময় পুলিশ তাদের প্রতিহত করে।’

হামলায় কেএনএফের শতাধিক সদস্য অংশ নিয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাদের বেশির ভাগের পরনে ইউনিফর্ম ছিল। সদস্যরা কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে সোনালী ব্যাংক, স্থানীয় মসজিদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনের দিকে যায়। ইউএনওর বাসভবনের দিকে তারা আনসার সদস্যদের অস্ত্র কেড়ে নেয়।
‘ঘোষণা দিয়েই’ বান্দরবানে হামলা
বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে ব্যাংকে হামলার তিন সপ্তাহ আগে এক ফেসবুক পেজ থেকে ‘বদলা নেওয়ার’ ঘোষণা দেয় পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসী এ সংগঠন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কর্তৃক তাদের দুই সদস্যকে আটকের ‘ফিডব্যাক’ হিসেবে তারা এ ঘোষণা দিয়েছিল।
‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি- কেএনএ’ নামের এক ফেসবুক পেজ থেকে ১২ মার্চ পোস্ট করা হয়। ওই পোস্টে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চুক্তি ভঙ্গ করে বম সম্প্রদায়ের নিরীহ জনগণ লালমুয়ানওম বম (গিলগাল বা অবচলিত পাড়া) এবং রামনুয়াম বমকে (দুনিবার পাড়া) আটক করেছে। এর ফল খুব সুন্দরভাবে ফিডব্যাক দেওয়া হবে।’
থানচিতে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে কেএনএফের গোলাগুলি
এদিকে ঘটনার পর ৪ এপ্রিল বিকেল থেকে মুন্নমপাড়া, আত্তাপাড়া সীমান্তবর্তী এলাকায় কেএনএফের সঙ্গে যৌথবাহিনীর কয়েক দফা গোলাগুলি হয়। রাত সাড়ে ৮টার পর থানচিতে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলির তথ্য মিলেছে।

থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন জানান, রাত সাড়ে আটটা থেকে থানচি বাজার ও স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এলাকায় কেএনএফের সঙ্গে পুলিশ ও বিজিবির তুমুল সংঘর্ষ চলে।
আতঙ্কে রুমার বাসিন্দারা
রুমা উপজেলায় গেলে দেখা যায়, সবার চোখে-মুখে আতঙ্ক। রাস্তাঘাট নীরব। দোকানপাটও খোলেনি তেমন।
রুমা উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে হামলার প্রত্যক্ষদর্শী মসজিদের ইমাম নুরুল ইসলাম বলেন, হামলার আগে সন্ত্রাসীরা ব্যাংকের ব্যবস্থাপক নেজাম উদ্দিনকে ধরতে মসজিদে যান। মসজিদের ইমামসহ সব মুসল্লিদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে রাখেন অস্ত্রধারীরা। সেখান থেকে নেজাম উদ্দিনকে নিয়ে যায় তারা।
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বান্দরবান পার্বত্য জেলা একসময় খুব শান্তিপ্রিয় ছিল। কিন্তু সম্প্রতি সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ব্যাংক ডাকাতি, অস্ত্র লুট ও অপহরণের মতো বড় ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম করছে। এর আগেও এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বিভিন্ন জায়গায় বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী কার্যক্রম করেছে। এসব কার্যক্রম আমরা আন-চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেবো না। এদের পেছনে কোনো ইন্ধন আছে কি না তা বের করে আনা হবে। ডাকাতির ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে।

কেএনএফ প্রধান নাথান বম, চারুকলার ছাত্র থেকে পাহাড়ের সন্ত্রাস