
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে প্রবল প্রতিযোগিতা, প্রযুক্তিগত রূপান্তর এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই পরিবর্তনের ঢেউয়ে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি (এমটিবি)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিন দশকেরও বেশি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই ব্যাংকার টেকসই ব্যাংকিং, প্রযুক্তি-নির্ভর সেবা এবং সামাজিক দায়বদ্ধতাকে একই সূত্রে গেঁথে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংককে দেশের শীর্ষস্থানীয় ও স্থিতিশীল ব্যাংকের তালিকায় নিয়ে গেছেন।
পেশাগত জীবনের শুরু ১৯৮৮ সালে, সৌদি–বাংলাদেশ শিল্প ও কৃষি বিনিয়োগ সংস্থা (SABINCO)-তে মনিটরিং অফিসার হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তিনি আইডিএলসি, ANZ গ্রিন্ডলেস, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড, সিটিব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও ঢাকা ব্যাংকে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। কর্পোরেট, রিটেইল ও ইনস্টিটিউশনাল ব্যাংকিং—সব ক্ষেত্রে দক্ষতা ও কৌশলগত চিন্তার প্রমাণ রেখে তিনি ধীরে ধীরে শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে আসেন। ২০২০ সালে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি ও সিইও হিসেবে যোগদানের পর থেকে ব্যাংকটির ব্যবসায়িক কৌশল, প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে তিনি ধারাবাহিকভাবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন।
২০২৪ সাল ছিল মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের জন্য এক মাইলফলক। বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই রেটিংয়ে এমটিবি স্থান করে নেয়, যা প্রমাণ করে যে কর্পোরেট ঋণনির্ভর কাঠামো থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকটি সফলভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও পরিবেশবান্ধব অর্থায়নের মডেল বাস্তবায়ন করেছে। কৃষি, এসএমই, কুটির শিল্প এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ অর্থায়ন কর্মসূচি, এনজিও পার্টনারশিপের মাধ্যমে ক্ষুদ্রঋণ, বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড যানবাহন ক্রয়ে ঋণ এবং পরিবেশবান্ধব উদ্যোক্তা সহায়তা, টেকসই ব্যাংকিং মডেলের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মধ্যে ডিজিটাল ন্যানো ঋণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, যা স্বয়ংক্রিয়, কাগজবিহীন এবং সম্পূর্ণ অনলাইন প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের হাতে পৌঁছে যায়। এই উদ্ভাবনী পণ্য গ্রাহককে ব্যাংকে না গিয়েই ঋণ গ্রহণের সুযোগ দেয়, যা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বাস্তব উদাহরণ।
এমটিবি-র সাফল্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রযুক্তি রূপান্তর। ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করে ব্যাংকটি, যখন ইউরোমানি এমটিবি-কে “বাংলাদেশের সেরা ডিজিটাল ব্যাংক” হিসেবে ঘোষণা করে। ব্যাংকের স্মার্ট ব্যাংকিং অ্যাপ, ক্যাশ-বাই-কোড, ভার্চুয়াল কার্ড, এজেন্ট ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক, টরিত লোন এবং কুইক অ্যাকাউন্ট সেবা গ্রাহক অভিজ্ঞতাকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। এ ছাড়া ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়নের ফলে সারা দেশে গ্রাহকসেবা দ্রুত, নিরাপদ এবং সাশ্রয়ী হয়েছে। ২০২৫ সালে গ্লোবাল এক্সেলেন্স ক্রনিকল ম্যাগাজিন ব্যাংকটিকে “বাংলাদেশের সেরা বাণিজ্যিক ব্যাংক” স্বীকৃতি দেয়—যা লাভজনকতা, কম নন-পারফর্মিং লোন অনুপাত এবং শক্তিশালী মূলধন কাঠামোর যৌথ প্রতিফলন।
ব্যাংকের গ্রাহকভিত্তি ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী, এমটিবি-তে ১৩ লাখ ৬১ হাজার গ্রাহকের হিসাব রয়েছে, যার মধ্যে ৪৫ হাজারেরও বেশি ঋণ হিসাব। ডেবিট কার্ড ব্যবহারকারী ৩ লাখ ৭৯ হাজার এবং ক্রেডিট কার্ড গ্রাহক ১ লাখ ৪৬ হাজার। মোবাইল ব্যাংকিং গ্রাহক সংখ্যা ১ লাখ ৫৯ হাজারে পৌঁছেছে। এই পরিসংখ্যান দেখায় যে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যাংকিং সেবা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গেছে।
টেকসই ব্যাংকিংয়ের অংশ হিসেবে এমটিবি পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। সৌরবিদ্যুৎ-চালিত শাখা, কাগজবিহীন ব্যাংকিং, ই-স্টেটমেন্ট, পানি ও জ্বালানি সাশ্রয়ী অফিস পরিচালনা, গ্রাহককে ডিজিটাল চ্যানেল ব্যবহারে উৎসাহ—এসবই ব্যাংকের পরিবেশ সচেতনতা ও খরচ দক্ষতার উদাহরণ। ২০২৫ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসে উপকূলীয় অঞ্চলে ম্যানগ্রোভ বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি ছিল ব্যাংকের অন্যতম বড় সামাজিক উদ্যোগ। কর্মীরা ব্যক্তিগতভাবে এই কর্মসূচিতে অংশ নেন এবং স্থানীয়দের হাতে পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী তুলে দেন।
সামাজিক দায়বদ্ধতায় এমটিবি সমানভাবে সক্রিয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাংকের সিএসআর তহবিল নিয়মিত ব্যয় হয়। স্কুলশিক্ষার্থীদের বাইসাইকেল প্রদান, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় জলবায়ু সহনশীল ব্যাগ বিতরণ, নিরাপদ পানির ব্যবস্থা এবং অভিযোজিত কৃষি প্রশিক্ষণ—এসব উদ্যোগ স্থানীয় সম্প্রদায়ের জীবনমান উন্নয়নে সরাসরি অবদান রাখছে।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকটি ১০ম বার্ষিক সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যা গ্লোবাল রিপোর্টিং ইনিশিয়েটিভ (GRI) স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রস্তুত। এই রিপোর্টে ব্যাংকের ইএসজি (Environmental, Social, Governance) অঙ্গীকার, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এবং টেকসই অর্থায়নের অগ্রগতি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাসটেইনেবল ফাইন্যান্স বিভাগের প্রতিনিধিরাও এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, যা নিয়ন্ত্রক সংস্থার স্বীকৃতিও নিশ্চিত করে।
কমপ্লায়েন্স সংস্কৃতিতেও এমটিবি শক্ত অবস্থানে আছে। ২০২৪ সালে আয়োজিত বাৎসরিক ট্রেড-বেসড কমপ্লায়েন্স কনফারেন্সে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন এবং ট্রেড-ভিত্তিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সঠিক নথিপত্র, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং তথ্য যাচাইয়ের ওপর তিনি জোর দেন, যা ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য কার্যক্রমকে সুরক্ষিত রাখে।
এই দীর্ঘ যাত্রায় সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বের দর্শন ছিল স্পষ্ট—গ্রাহক সন্তুষ্টি, ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তি প্রয়োগ এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মধ্যে সুষম সমন্বয়। তাঁর মতে, একটি আধুনিক ব্যাংকের সাফল্য কেবল আর্থিক মুনাফায় নয়, বরং গ্রাহকের আস্থা, কর্মীদের দক্ষতা এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতায় নিহিত। এমটিবি-কে তিনি এমন একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়েছেন, যা একই সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক, লাভজনক এবং মানবিক।
পেশাগত সাফল্যের বাইরে সৈয়দ মাহবুবুর রহমান ব্যক্তিগত জীবনেও সমান দৃঢ় ও প্রগতিশীল। স্ত্রী ও দুই কন্যাসন্তানকে নিয়ে তাঁর পারিবারিক জীবন স্থিতিশীল, যা তাঁর পেশাগত দায়িত্ব পালনে দৃঢ়তা ও অনুপ্রেরণা যোগায়। কর্পোরেট জগতে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কাজ করার অভ্যাস এবং স্থানীয় প্রেক্ষাপটের গভীর বোঝাপড়া—সব মিলিয়ে তিনি আজকের বাংলাদেশের অন্যতম প্রভাবশালী ও সফল ব্যাংকিং নেতাদের একজন।
আজ মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক যেখানেই দাঁড়িয়ে আছে, তা শুধু একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের গল্প নয়; এটি নেতৃত্ব, দূরদর্শিতা, এবং টেকসই উন্নয়নের প্রতি অবিচল প্রতিশ্রুতির গল্প। সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের হাতে এমটিবি শুধু একটি ব্যাংক নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের এক নির্ভরযোগ্য অংশীদার হয়ে উঠেছে।