২০০৯ সালের ৭ এপ্রিলে কথা। তখন ড্যানিশ ও যুক্তরাষ্ট্রের কার্গো জাহাজ মারস্ক অ্যালবাবা ছিনতাই করেছিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা। সেটা ছিল এক ভয়াবহ ঘটনা। জাহাজটির ক্যাপ্টন ছিলেন রিচার্ড ফিলিপস। জিম্মি অবস্থায় দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি। সেই ঘটনা নিয়ে পরবর্তীতে সিনেমায় তৈরি হয়। যা তখন বেশ আলোড়ন তোলে। এমনই আরেকটি ঘটনার মুখোমুখি বাংলাদেশি ২৩ নাবিক। গত ১২ মার্চ বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এখন পুরোপুরি সেই জাহাজটি তাদের নিয়ন্ত্রণে। আর নাবিকদের আটকে রাখা হয় জাহাজের একটি রুমে।
জাহাজটি বর্তমানে সোমালিয়ার গারাকাড উপকূল থেকে ২০ মাইল দূরে অবস্থান করছে। উপকূলে পৌঁছাতে আর মাত্র দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগতে পারে। এরপরই এর নিয়ন্ত্রণে নেবে জলদস্যুদের আরেকটি দল। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন এমনটিই জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি এক নাবিক গোপনে এক বার্তায় জানিয়েছেন, তাদের উদ্ধারের জন্য অভিযান চালিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি যুদ্ধজাহাজ। দুই পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হলেও জিম্মিদের হত্যার শঙ্কায় পরে পিছিয়ে যায় নেভি জাহাজটি।
তিনি বলেন, গতকাল রাতে (বুধবার দিনগত রাত) নেভির একটা জাহাজ আমাদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। এরা (জলদস্যুরা) আমাদের দেয়নি। ওরা (উদ্ধারে আসা জাহাজ) বাইরে থেকে ফায়ার করেছে। তখন জলদস্যুরা বলছে আমরা (বাংলাদেশি নাবিকরা) হোস্টেজ (জিম্মি) আছে। ওরা (উদ্ধারে আসা জাহাজ) যদি হামলা করে, তাহলে আমাদের মেরে ফেলবে।’
এখন প্রশ্ন হচ্ছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা কীভাবে এত শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ হলো। তাদের উত্থানই বা হলো কীভাবে। এ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এসব সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা খুবই ভয়ংকর। তাদের হাতে অত্যাধুনিক অস্ত্র রয়েছে।
উত্থানের নেপথ্যে
ইতালির ঔপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণ থেকে বেরিয়ে ১৯৬০ সালে সোমালিয়ার জন্ম। ১৯৯১ সালে সামরিক শাসন উৎখাতের পরে নৈরাজ্যের মধ্যে পড়ে পূর্ব আফ্রিকার দেশটি। পরের দুই দশকের বেশি সময় যুদ্ধবিগ্রহে বিধ্বস্ত সোমালিয়ায় কার্যকর কোনো সরকার ছিল না। এ সময়ে আফ্রিকার মধ্যে দীর্ঘতম উপকূল সমৃদ্ধ দেশটির জলসীমার নিরাপত্তায় কোনো কোস্টগার্ড বা বাহিনীও ছিল না। এতে এ অঞ্চলে বিদেশি মাছ ধরা নৌযানের উপস্থিতি ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাতে স্থানীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। ফলে, তারা দস্যুবৃত্তির দিকে ঝুঁকে পড়ে।
ইন্ডিয়ান ওশান কমিশনের সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতেও ওই সময়ের দস্যুতার নেপথ্যে এই কারণ দেখানো হয়েছে। তাছাড়া, মৎস্য শিকারের চেয়ে দস্যুতায় আয়ের পরিমাণও অনেকগুণ বেশি। তবে, কয়েক বছর তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলো ওই রুটে নিজেদের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এর ফলে ২০১২ সাল নাগাদ অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসে সোমালিয়দের দস্যুবৃত্তি।
দস্যুদের আয় কেমন?
২০০৫ থেকে ২০১২ পর্যন্ত আফ্রিকার দস্যুরা কী পরিমাণ অর্থ আদায় করেছে তার একটি আনুমানিক হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী, জলদস্যুরা ক্রুদের জিম্মি করে ৩৫০ থেকে ৪২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ আদায় করেছে। এই পরিসংখ্যান তুলে ধরে নাইজেরিয়ার ফেডারেল ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্যামুয়েল ওয়েওল বলেন, ছিনতাইয়ের পেছনে মূল লক্ষ্য মুক্তিপণ আদায়।
জলদস্যুদের জীবন-যাপন
জাহাজ ও নাবিকদের জিম্মি করে বিপুল অর্থ আয় করে জলদস্যুরা। সেসব অর্থ খরচও করে হাত খুলে। জলদস্যুদের শীর্ষ নেতাদের চোখের পলকে ১০ লাখ ডলার খরচ করা কোনো ব্যাপারই নয়। মুক্তিপণের অর্থ পার্টি করে, মদ খেয়ে, নারীদের পেছনে উড়িয়ে দেয়। আবার অনেকে বাড়ি করে গাড়ি কেনে। যা মন চায় তাই করে।